পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘না আমাদের এখানে থাকাই ভালো। এখন চলিয়া গেলে উহারা আর কোনো ফন্দি করিয়া আমাদিগকে মারিবে। তাহার চেয়ে এই ঘর পোড়াইবার সময় উহাদিগকে ফাঁকি দিয়া আমরা পলাইয়া গেলে লোকে ভাবিবে, আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিয়াছে। আর এ কথা শুনিলে ভীষ্ম, দ্রোণ ইঁহারাও ইঁহাদের উপর খুব বিরক্ত হইবেন। এখন হইতে খুব শিকার করিয়া বেড়াইলে আমরা পথ-ঘাট সবই জানিতে পারিব, আর পলাইবার সময় কোনো মুস্কিলও হইবে না। আজই এই ঘরের ভিতরে একটা গর্ত খুঁড়িয়া, আমরা তাহার মধ্যে থাকিব, তাহা হইলে আর আগুনের ভয় থাকিবে না৷’

 ইহার মধ্যে একদিন একটি লোক চুপিচুপি যুধিষ্ঠিরের নিকট আসিয়া বলিল, ‘বিদুর মহাশয় আমাকে আপনার নিকট পাঠাইয়াছেন। আমি প্রাণ দিয়া আপনাদের কাজ করিব। আপনারা আসিবার সময় তিনি ম্লেচ্ছ ভাষায় আপনাকে কিছু বলেন, তাহার উত্তরে আপনি বলেন যে, ‘বুঝিলাম’ এই কথা বলিলেই বুঝিতে পারিবেন যে আমি যথার্থই বিদুরের লোক। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পুরোচন এই ঘরসুদ্ধ আপনাদিগকে পোড়াইয়া মারিবার যুক্তি করিয়াছে। এখন কি করিতে হইবে বলুন, আমি খুব গর্ত খুঁড়িতে পারি৷

 লোকটিকে দেখিয়াই যুধিষ্ঠির বুঝিতে পারিলেন যে, এ ব্যক্তি খুব সরল ও ধার্মিক। তিনি তাহাকে বলিলেন, ‘আমি বেশ বুঝিয়াছি তুমি ভালো লোক, আর কাকা তোমাকে পাঠাইয়াছেন। এখন যাহাতে আমরা এ বিপদে রক্ষা পাই তাহাই কর৷’

 সেই লোকটি ঘরের মধ্যে নর্দমা কাটিবার ছল করিয়া এক প্রকাণ্ড গর্ত খুঁড়িয়া ফেলিল। পাণ্ডবেরা দিনের বেলায় শিকার করিয়া বেড়াইতেন, রাত্রিতে সেই গর্তের ভিতরে সাবধানে লুকাইয়া থাকিতেন। গর্তের মুখ এমনভাবে লুকানো ছিল যে, না জানিলে তাহা টের পাওয়া অসম্ভব। উহার কথা খালি পাণ্ডবেরা জানিলেন, আর যে গর্ত খুঁড়িয়াছিল সে জানিত, আর কেহই জানিত না। ক্রমে সেই কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী আসিল, যেদিন পুরোচনের সেই গালার ঘরে আগুন দেওয়ার কথা। সেদিন কুন্তী অনেক ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য লোককে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইলেন। একটি নিষাদী, অর্থাৎ ব্যাধজাতীয় স্ত্রীলোক ও তাহার পাঁচটি পুত্র লইয়া সেখানে খাইতে আসিল। গরিব লোক, ভালো খাবার পাইয়া এতই খাইল যে তাহাদের চলিয়া যাইবার শক্তি নাই। কাজেই তাহারা ছয়জন সেইখানে রহিল৷

 এদিকে ক্রমে ঢের রাত হইয়াছে, আর খুব বাতাসও বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। সকলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে পুরোচনও নিদ্রায় অচেতন। সেই সুন্দর সুযোগ পাইয়া ভীম তখনই তাড়াতাড়ি তাহার ঘরের দরজায় আগুন লাগাইয়া দিলেন। তারপর বাড়ির চারিদিকে বেশ ভালোরূপে আগুন ধরাইয়া, পাঁচ ভাই মায়ের সঙ্গে সেই গর্তের ভিতর দিয়া বাহিরে চলিয়া আসিলেন। পুরোচন আর পাঁচপুত্র সমেত সেই নিষাদী পুড়িয়া মারা গেল৷

 আগুনের শব্দে শহরের লোকের জাগিতে অনেকক্ষণ লাগিল না। তাহারা আসিয়া ‘হায় হায়’ করিতে করিতে পুরোচন আর দুর্যোধনকে গালি দিতে লাগিল। পাণ্ডবদিগকে পোড়াইয়া মারিবার জন্যই যে পুরোচন দুর্যোধনের কথায় এই ঘর প্রস্তুত করিয়াছিল, একথা আর তাহাদের বুঝিতে বাকি রহিল না। তাহারা বলিল, ‘দুষ্ট নিজেও পুড়িয়া মরিয়াছে বেশ হইয়াছে। যেমন কর্ম তেমন ফল৷’

 এতক্ষণ পাণ্ডবেরা কি করিতেছেন? তাঁহারা প্রাণপণে বনের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছেন৷