পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
১৮৭

কিন্তু চলা কি যায়? একে ভয়ে অস্থির, তাহাতে রাত জাগিয়া দুর্বল। অন্ধকার রাত্রি, ঝড় বহিতেছে। তাঁহারা পদে পদে উঁচট খাইতেছেন, পা আর চলে না। তখন ভীম আর উপায় দেখিয়া মাকে লইলেন কাঁধে, আর নকুল সহদেবকে কোলে। তারপর যুধিষ্ঠির আর অর্জুনের হাত ধরিয়া লইয়া ঝড়ের মতন ছুটিয়া চলিলেন৷

 এদিকে বিদুর পাণ্ডবদিগের সাহায্য করিবার জন্য আর-একজন খুব পাকা লোক পাঠাইয়া দিলেন। সে খুঁজিতে খুঁজিতে গঙ্গার ধারে আসিয়া দেখিল যে, তাঁহারা নদী পার হইবার চেষ্টায় জল মাপিতেছে। তখন সে সেই ম্লেচ্ছ ভাষার ঘটনার কথা বলিতেই তাহার প্রতি পাণ্ডবদের বিশ্বাস জন্মিল। তারপর একটি সুন্দর নৌকা আনিয়া তাঁহাদিগকে বলিল, ‘চলুন আপনাদিগকে পার করিয়া দিই৷’

 নৌকা বাহিতে বাহিতে সেই লোকটি তাঁহাদিগকে বলিল, ‘বিদুর মহাশয় আপনাদিগকে অনেক আশীর্বাদ জানাইয়াছে, আর বলিয়াছে, আপনাদের কোনো ভয় নাই, শেষে আপনাদেরই জয় হইবে৷’

 পাণ্ডবেরা বলিলেন, ‘কাকাকে আমাদের প্রণাম জানাইবে।’

 এইরূপ কথাবার্তায় নৌকা অপর পারে উপস্থিত হইলে, লোকটিকে বিদায় দিয়া পাণ্ডবেরা আবার পথ চলিতে লাগিলেন৷

 এদিকে সকালবেলায় বারণাবতের লোকেরা পাণ্ডবদিগকে খুঁজিতে আসিয়া গালার ঘরের ছাইয়ের ভিতরে পুরোচন আর সেই নিষাদী আর তাহার পাঁচ ছেলের পোড়া হাড় পাইল। তাহারা নিষাদীর কথা জানিত না, কাজেই এই হাড় কুন্তী আর পাঁচ পাণ্ডবের মনে করিয়া তাহার কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘চল আমরা দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্রকে গিয়া বলি, ‘তোমার সাধ পূর্ণ হইয়াছে, পাণ্ডবদিগকে পোড়াইয়া মারিয়াছ।’

 ইহার মধ্যে সেই যে লোকটি গর্ত খুঁড়িয়াছিল, সে তাড়াতাড়ি ছাই উল্টাইবার ছল করিয়া সেই গর্ত কখন বুজাইয়া দিয়াছিল, কাজেই তাহার কথা কেহ জানিতে পারিল না৷

 ধৃতরাষ্ট্র শুনিলেন যে, পুরোচন আর পাণ্ডবেরা জতুগৃহের (গালার ঘরের) সঙ্গে পুড়িয়া মারা গিয়াছে, তখন তিনি মনে মনে খুবই খুশি হইলেন, কিন্তু বাহিরে দেখাইলেন যেন পাণ্ডবদের দুঃখে তাঁহার বুক একেবারে ফাটিয়া গেল। তিনি কাঁদেন আর বলেন, “হায় হায়! শীঘ্র উহাদের শ্রাদ্ধ কর! হায় হায়! ঢের টাকা খরচ কর! হায় হায় একটি নদী খোঁড়াও! হায় হায়! পাণ্ডবেরা ভালো করিয়া স্বর্গে যাউক৷”

 আর-একজন লোক এমনি কপট কান্না কাঁদিয়াছিলেন, কিন্তু সে অন্য কারণে। বিদুর তো জানেনই যে পাণ্ডবেরা বাঁচিয়া আছে, কাজেই তাঁহার কেন দুঃখ হইবে? কিন্তু দেশসুদ্ধ লোক পাণ্ডবদের জন্য ‘হায় হায়’ করিয়া কাঁদিতেছে, ইহার মধ্যে তিনি চুপ করিয়া থাকিলে তো ভারি সন্দেহের কথা হয়। কাজেই তিনি আসল কথা জানিয়াও লোকের সন্দেহ দূর করিবার জন্য একটু কাঁদিলেন৷

 এদিকে পাণ্ডবেরা গঙ্গা পার হইয়া আবার ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে চলিয়াছেন। তখন রাত্রি প্রভাত হয় নাই, চারিদিকে ঘোর অন্ধকার আর ভয়ংকর বন। পিপাসায়, পরিশ্রমে আর ঘুমে ভীম ছাড়া আর সকলেই নিতান্ত কাতর। যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘ভীম! ভাই, আর যে পারি না। এখন উপায়?’