পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 ভীম বলিলেন, ‘ভয় কি দাদা? এই যে আমি আপনাদিগকে লইয়া যাইতেছি৷’ এই বলিয়া তিনি পূর্বের ন্যায় সকলকে বহিয়া লইয়া ছুট দিলেন৷

 ভীম সেদিন কি ভয়ানক বেগেই চলিয়াছিলেন। তাঁহার দাপটে গাছ ভাঙ্গে, মাটি উড়ে, আর যুধিষ্ঠিরেরা তো প্রায় অজ্ঞান! বনের পর বন পার হইয়া যাইতেছে, তবুও তাঁহার বিশ্রাম নাই। রাত চলিয়া গেল, তারপর সমস্তটা দিন চলিয়া গেল। সন্ধ্যার সময় একটা বনের ভিতরে আসিয়া ভীম থামিলেন। ক্রমে ঘোর অন্ধকার আসিল, ঝড় উঠিল, চারিদিকে বাঘ ভাল্লুক ডাকিতে লাগিল, কিন্তু পাণ্ডবেরা আর কিছুতেই চলিতে পারেন না, কাজেই সেখানে বিশ্রাম করা ভিন্ন আর উপায় নাই৷

 এমন সময় কুন্তী বলিলেন, ‘আর তো পারি না! পিপাসায় যে প্রাণ গেল!’ মায়ের দুঃখ ভীমের সহ্য হয় না, অথচ সে পোড়া বনে জল বা ফলমূল কিছুই নাই। কাজেই তিনি আবার সকলকে লইয়া আর-একটা সুন্দর বনে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে এক প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় তাঁহাদিগকে রাখিয়া তিনি বলিলেন, ‘এইখানে তোমরা বিশ্রাম কর। ঐ সারসের ডাক শুনা যাইতেছে, জল কাছেই পাইব৷’

 ভীম সারসের ডাক শুনিয়া খুঁজিতে খুঁজিতে দুই ক্রোশ দূরে একটা জলাশয়ে উপস্থিত হইলেন। সেখানে স্নান আর জলপানের পর আর সকলের জন্য জল লইয়া আসিয়া দেখেন, তাঁহারা ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন৷

 হায়! রাজরানী, রাজার ছেলে, তাঁহারা কিনা আজ মাটিতে গড়াগড়ি যাইতেছেন! দুঃখে ভীমের চোখে জল আসিল। তখন শত্রুদিগের হিংসার কথা ভাবিয়া তিনি বাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, ‘দুষ্ট দুর্যোধন! তোর বড় ভাগ্য যে দাদা আমাকে বলেন না। নহিলে আজই তোদের সকলকে যমের বাড়ি পাঠাইতাম।’ বলিতে বলিতে ভীমের ঝড়ের মত নিশ্বাস বহিতে লাগিল৷

 এত কষ্টের পর সকলে ঘুমাইয়াছেন, কাজেই তাঁহাদিগকে জল খাওয়াইবার জন্য জাগাইতে ভীমের ইচ্ছা হইল না। তিনি জল হাতে করিয়া সেখানে পাহারা দিতে লাগিলেন৷

 সেই বনের কাছে, এক প্রকাণ্ড শাল গাছের উপরে, হিড়িম্ব নামে একটা বিকট রাক্ষস থাকিত। তাহার তালগাছের মতো বিশাল দেহে ভয়ানক জোর, আগুনের মতো চোখ, জালার মতো মুখ, মূলার মতো দাঁত, গাধার মতো কান, ঝাঁকড়া তামাটে চুল-দাড়ি, বেলুনের মতো প্রকাণ্ড ভুঁড়ি। অনেকদিন মানুষের মাংস খায় নাই, তাই পাণ্ডবদিগকে দেখিয়া তাহার মুখে জল আর ধরে না। সে খালি মাথা চুলকায়, আর হাঁই তোলে, আর বারবার তাঁহাদিগকে চাহিয়া দেখে। শেষে আর থাকিতে না পারিয়া সে তাহার বোন হিড়িম্বাকে বলিল, ‘বাঃ! কি এ মিঠঠারে গন্ধো! ও বোহিন্, ঝট্ কোরে ধোরে লিয়ে আয়! মোরা খাবো! আর পেটমে ঢাক পিট্টায়কে নাচ্চ্‌বো!’

 হিড়িম্বা তাহার কথায় পাণ্ডবদের কাছে আসিল। কিন্তু রাক্ষসের মেয়ের প্রাণেও দয়ামায়া খুব থাকিতে পারে। পাণ্ডবদিগকে মারিবার কোনো চেষ্টা করা দূরে থাকুক, বরং সে আসিয়াই ভীমকে সকল কথা জানাইয়া বলিল, ‘শীঘ্র সকলকে জাগাও। আমি তোমাদিগকে রাক্ষসের হাত হইতে বাঁচাইয়া দিতেছি৷’

 ভীম বলিলেন, ‘আমি রাক্ষস-টাক্ষসকে ভয় করি না। ইহারা অনেক পরিশ্রমের পর