পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
১৯১

 ইহার মধ্যে একদিন কি হইল শুন। সেদিন যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল আর সহদেব ভিক্ষায় বাহির হইয়াছেন। ভীমের সেদিন যাওয়া হয় নাই, তিনি মায়ের কাছেই রহিয়াছে। ইহার মধ্যে হঠাৎ সেই ব্রাহ্মণের বাড়ির ভিতরে ভয়ানক কান্না উঠিল৷

 কান্না শুনিয়া কুন্তী ভীমকে বলিলেন, ‘না জানি ব্রাহ্মণের কি ভয়ানক বিপদ উপস্থিত হইয়াছে! ইনি আমাদিগকে এত স্নেহ করেন, আমরা কি ইঁহার কোনো উপকার করিতে পারি না, বাবা?’

 ভীম বলিলেন, ‘মা, তুমি জানিয়া আইস, বিষয়টা কি? সাধ্য হইলে অবশ্য ব্রাহ্মণের উপকার করিব৷’ কথা শেষ হইতে না হইতেই আবার সেই কান্না। তখন কুন্তী ব্যস্তভাবে ছুটিয়া বাড়ির ভিতর গিয়া দেখিলেন, ব্রাহ্মণ স্ত্রী কন্যা আর পুত্র লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিতেছেন, ‘হায়, কেন বাঁচিয়া আছি? বাঁচিয়া থাকায় কি সুখ? আমি আগেই এখান হইতে চলিয়া যাইতে চাহিয়াছিলাম, গিন্নি! তুমিই তো দিলেন না! তোমার বাপের বাড়ি বলিয়া এ স্থান ছাড়িতে তোমার কষ্ট হইয়াছিল, তাহার ফলে দেখ এখন কি কষ্ট উপস্থিত! হায় হায়! আমি কাহাকে ছাড়িব? আর তোমাদিগকে বিপদে ফেলিয়া নিজেই বা কি করিয়া যাইব? তাহার চেয়ে চল আমরা সকলেই একসঙ্গে মরি৷’

 তাহা শুনিয়া বাহ্মণী বলিলেন, ‘ওগো তুমি এমন কথা বলিও না। তোমরা থাক, আমি যাই! তুমি গেলে আমরা কেহই বাঁচিব না। কিন্তু আমি গেলে তুমি মেয়েটিকে আর ছেলেটিকে মানুষ করিতে পারিবে।’

 বাপমায়ের কথা শুনিয়া মেয়েটি বলিল, ‘মা, বাবা, তোমরা কেন কাঁদিতেছ? আমি যাহা বলিতেছি, তাহা কর। দেখ বাবা, আমাকে আর তোমরা কয়দিন রাখিতে পারিবে? বিবাহ হইলে তো আমি তোমাদিগকে ছাড়িয়া যাইব। তাহাই যদি হইল, তবে এখনই কেন আমি যাই না? তোমরা কেহ গেলে কি ভাইটি বাঁচিবে? ভাবিয়া দেখ, আমি গেলে সকল দিকই রক্ষা হয়৷

 তখন ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী মেয়েটিকে জড়াইয়া ধরিয়া আরো ভয়ানক কাঁদিতে লাগিলেন৷

 ছোট ছেলেটি ইহার মধ্যে কোথায় একগাছি খড় কুড়াইয়া পাইয়াছে, সেই খড় দেখাইয়া সে সকলকে বলিল, “থি! তাঁদে না! এই দান্দা দে আমি নাত্থচ মালবো!” শিশুর কথায় সেই দুঃখের ভিতরেও সকলের হাসি পাইল৷

 কুন্তী এতক্ষণ দাঁড়াইয়াছিলেন। উহাদিগকে একটু হাসিতে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কিজন্য কাঁদিতেছেন? আপনাদের কিসের দুঃখ বলুন, আমাদের সাধ্য থাকিলে তাহা দূর করিব।”

 ব্রাহ্মণ বলিলেন, “মা, আমাদের দুঃখ কি মানুষে দূর করিতে পারে? এই নগরের কাছেই বক বলিয়া একটা রাক্ষস থাকে। সে আমাদিগকে বাঘ ভাল্লুক আর শত্রুর হাত হইতে রক্ষা করে, কিন্তু তাহার বদলে আমাদিগকে তাহার খাবার জোগাইতে হয়। রোজ একটি মানুষ, বিশ খারি ভাত আর দুটা মহিষ তাহার নিকট যাওয়া চাই। সে সেই ভাত মহিষ আর মানুষ সব খাইয়া শেষ করে। আমাদিগকে পালা করিয়া এক-একদিন এক-এক বাড়ি হইতে এসকল জিনিস পাঠাইতে হয়। যে না পাঠায়, দুষ্ট তাহার ছেলেপিলেসুদ্ধ সব মারিয়া খায়। এদেশের রাজা আমাদের কোন খবর নেন না, তাই রাক্ষসের হাতে আমাদের এই দুর্দশা৷