পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, “আমাদের সঙ্গে চলুন! আজ পাঞ্চাল দেশে বড় ধুমধাম হইবে, আমরা তাহা দেখিতে চলিয়াছি। সেখানকার রাজা যজ্ঞসেনের[১] মেয়ের স্বয়ম্বর। সেই মেয়ের গায়ের গন্ধ পদ্মের মতন। এক ক্রোশ দূর হইতে তাহা টের পাওয়া যায়। কত রাজা, কত পণ্ডিত, কত মুনি সেখানে আসিবেন, তাহার সীমা নাই। গান বাজনা, বাজি, কুস্তির কথা আর কি বলিব। পেট ভরিয়া ফলার পাইব, চোখ ভরিয়া তামাশা দেখিব, তারপর পুঁটলি ভরিয়া দান-দক্ষিণা লইয়া ঘরে ফিরব। চলুন আমরা একসঙ্গেই যাই আপনাদিগকে যেমন সুন্দর দেখিতেছি, চাই কি সেই মেয়ে আপনাদের কাহাকেও মালা দিয়া বসিতে পারে!

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “যে আজ্ঞা! আমরা আপনাদের সঙ্গে চলিলাম।”

 পাঞ্চালদেশে উপস্থিত হইয়া পাণ্ডবেরা এক কুমারের বাড়িতে বাসা লইলেন। সেইখানে তাঁহারা থাকেন, আর ভিক্ষা করিয়া খান।

 দ্রুপদের ইচ্ছা অর্জুনের সহিত দ্রৌপদীর বিবাহ হয়। সুতরাং যাহাতে অর্জুন ছাড়া আর কেহ দ্রৌপদীকে বিবাহ করিতে না পারে তিনি তাহার এক আশ্চর্য উপায় স্থির করিলেন।

 একটা ভয়ংকর ধনুক, তাহাকে কেহই বাঁকাইতে পারে না, সেই ধনুক বাঁকাইয়া তাহাতে গুণ পরাইতে হইবে। তারপর সেই ধনুকে তীর চড়াইয়া খুব উঁচুতে ঝুলানো একটা জিনিসকে বিধিতে হইবে। পথের মাঝখানে আবার একটা কলের মতন আছে, সেটার ভিতর দিয়া তীর গেলে তবে সেই জিনিসটাতে পৌঁছাইতে পারে।

 এতখানি কাজ করিয়া যে লক্ষ্য (অর্থাৎ যে জিনিসটাকে বিধিবার কথা, তাহা) বিঁধিতে পারিবে, সে দ্রৌপদীকে পাইবে। দ্রুপদ বুঝিয়াছিলেন যে, অর্জুন ছাড়া আর কাহারো সে ক্ষমতা নাই, কিন্তু তিনি এ কথা কাহাকেও বলিলেন না।

 স্বয়ম্বরের সংবাদ পাইয়া পৃথিবীতে যত রাজা আর রাজপুত্র আর যোদ্ধা আর বড়লোক সকলেই আসিয়া পাঞ্চাল দেশে উপস্থিত হইয়াছে। কর্ণ, দুর্যোধন, ভীষ্ম, দ্রোণ কেহই আসিতে বাকি নাই। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আর মুনি ঋষিতে পাঞ্চাল দেশ ছাইয়া গিয়াছে। দেবতারা পর্যন্ত না আসিয়া থাকিতে পারেন নাই।

 স্বয়ম্বরের স্থানটি যে কি সুন্দর করিয়া সাজাইয়াছে, তাহা না দেখিলে বলা কঠিন। বড়বড় জমকালো ফটক, কাজকবা উঁচু পাচিল, রংবেরঙের ঝালর, নিশান, পর্দা আর চাঁদোয়া, এই সকলের একটা খুব ঘটা মনে করিয়া লও। আর মনে কর, ইহার চারিধারে খাল, তাহাতে জল টলমল করিতেছে, পদ্মফুল ফুটিয়াছে, হাঁস চরিতেছে আর লাল মাছ খেলিতেছে। রাজারাজড়ার জন্য উঁচু উঁচু জায়গা হইয়াছে, তাহাতে বসিয়া তাঁহারা ভালো মতো দেখিতে পাইবেন। সাধারণ লোকেরও ভালোমতোই দেখিবার ইচ্ছ, কিন্তু তাহাদের জন্য আর কে উঁচু জায়গা রাখিবে? কাজেই তাহারা গাছে উঠিয়া রাজাদের চেয়েও ভালো দেখিবার জোগাড় করিল। যাহারা দেখিবার বেশি সুবিধা পাইল না, তাহারা খালি গোলমাল করিয়াই সাধ মিটাইতে লাগিল। উহাদের গলার শব্দই বেশি হইয়াছিল, না বাজনার শব্দই বেশি হইয়াছিল, তাহা ঠিক করিয়া বলা শক্ত।

 পনেরোদিন খালি গানবাজনাই চলিল। বোল দিনের দিন দ্রৌপদী স্নানের পর আশ্চর্য পোশাক এবং অলংকার পরিয়া সোনার মালা হাতে সভায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। অমনি

  1. দ্রুপদের আসল নাম যজ্ঞসেন।