পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
২১৭

আমি তাহার মাথায় পা তুলিয়া দিই৷”

 এইরূপ তর্ক আরম্ভ হইয়া ক্রমে বিষম কাণ্ড উপস্থিত হইল। কৃষ্ণের উপর শিশুপালের অনেকদিন হইতেই রাগ ছিল, আর তিনি নানারকমে তাঁহাকে অপমান করিতেও ত্রুটি করেন নাই। কৃষ্ণ এতদিন তাহা সহিয়া থাকিবার কারণ এই যে, তিনি শিশুপালের মায়ের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ‘আপনার পুত্রের একশত অপরাধ ক্ষমা করিব৷’

 শিশুপালের একশত অপরাধ ইহার পূর্বেই হইয়া গিয়াছে, সুতরাং আর তাঁহাকে ক্ষমা করিবার কোনো কারণ নাই।

 শিশুপাল ভয়ানক অপমানের কথা বলিয়া কৃষ্ণকে গালি দিতে দিতে শেষে বলিলেন, “আইস! আজ তোমাকে আর পাণ্ডবদিগকে যমের বাড়ি পাঠাইতেছি৷”

 তখন কৃষ্ণ সভার সকলকে বলিলেন, “আমি অনেক সহিয়াছি, কিন্তু এতগুলি রাজার সম্মুখে এমন অপমান আমি কিছুতেই সহিতে পারিব না৷”

 তাহা শুনিয়া শিশুপাল হো হো শব্দে হাসিতে হাসিতে আরো বেশি অভদ্রভাবে কৃষ্ণকে গালি দিতে লাগিলেন৷

 এমন সময় চাকার মতন একটা অতি ভয়ংকর জিনিস সভায় আসিয়া উপস্থিত হইল! কৃষ্ণ তাহাকে হাতে করিয়া লইলেন। ইহা কৃষ্ণের সেই সুদর্শন চক্র নামক অস্ত্র, কৃষ্ণ তাহাকে মনে মনে ডাকাতে অমনি ছুটিয়া আসিয়াছে। আজ আর শিশুপালের রক্ষা নাই৷

 চক্র হাতে লইয়া কৃষ্ণ সকলকে বলিলেন “এই দুষ্টের একশত অপরাধ ক্ষমা করিয়াছি আর ক্ষমা করিব না। এই দেখুন ইহাকে বধ করিলাম৷”

 এ কথা বলিবামাত্রই চক্র ছুটিয়া গিয়া শিশুপালের মাথা কাটিয়া ফেলিল। সভার সকল লোক পুতুলের ন্যায় দাঁড়াইয়া তাহা দেখিল, কাহারো মুখে কথা সরিল না৷

 এইরূপে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হইল। তারপর রাজারা দেশে চলিয়া গেলেন৷

 সকলে চলিয়া গিয়াছে, দুর্যোধন আর শকুনি তখনো যান নাই, তাঁহারা সভা দেখিতেছেন। এমন সভা দুর্যোধন আর কখনো দেখেন নাই, যত দেখেন, ততই তাঁহার ধাঁধা লাগিয়া যায়। ইহারই মধ্যে কয়েকবার তিনি স্ফটিকের মেঝেকে জল মনে করিয়া কাপড় গুটাইয়াছেন, আবার জলকে স্ফটিক ভাবিয়া, কাপড়-চোপড়সুদ্ধ তাহাতে হাবুডুবুও খাইয়াছেন। সকলে হাসিয়াছে ও যুধিষ্ঠিরের চাকরেরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে অন্য কাপড় আনিয়া দিয়াছে৷

 স্ফটিকের দেওয়াল, তাহাকে দুর্যোধন মনে করিলেন, বুঝি দরজা। তাহার ভিতর দিয়া বাহির হইতে গিয়া মাথায় ঠকাস্ করিয়া এমনি লাগিল যে, একেবারে মাথা ঘুরিয়া পড়িবার গতিক। তারপর বেচারার আর ভালো করিয়া চলিতেই ভরসা হয় না, খালি ‘কানা মাছি ভোঁ ভো’র মতন হওয়াতে হাত বুলাইতে বুলাইতে পা বাড়াইতেছে। এমনি করিয়া শেষে একবার একেবারে বাহিরে গিয়া ধপাস! তারপর দরজা দেখিলেই আগে থাকিতে দাঁড়ান৷

 বাস্তবিক এমন করিয়া নাকাল হইলে বড্ড রাগ হয়! অথচ সে রাগ দেখাইবার জো নাই, কারণ তাহাতে লোকে আরো হাসে। কাজেই দুর্যোধন জিব ঠোট কামড়াইয়া কোনমতে রাগ হজম করিয়া সেখান হইতে বিদায় হইলেন। এদিকে কিন্তু হিংসায় তিনি জ্বলিয়া মরিতেছেন। পথে শকুনি তাঁহাকে কত কথা বলিয়াছেন, তিনি কিছুরই উত্তর দেন নাই। শেষে শকুনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হইয়াছে দুর্যোধন, কথা কহিতেছ না যে?’

উপেন্দ্র—২৮