পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

সোনার কুম্ভ, আর আমার ভাণ্ডারের সকল ধনরত্ন পণ রহিল।’

 শকুনি তখনই ‘এই জিতিলাম' বলিয়া সে-সব জিতিয়া লইলেন। তাঁহার ফাঁকি কেহ ধরিতে পারিল না৷

 হায় হায়! পাশায় কি সর্বনাশ হইল! যুধিষ্ঠির যত হারেন, ততই তাঁর জেদ চড়িয়া যায়, আর ততই তিনি বলেন, ‘আরো খেলিব!’ ধূর্ত শকুনির জুয়াচুরি কাহারো ধরিবার সাধ্য নাই। পণ রাখিবামাত্রই তিনি ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া পাশা ফেলেন, আর যুধিষ্ঠির হারিয়া যান৷

 এইরূপে ক্রমে তাঁহার দাসী গেল, চাকর গেল, হাতি গেল, ঘোড়া গেল, রথ গৈল, সৈন্য গেল—সব গেল৷

 সর্বনাশ উপস্থিত দেখিয়া বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলিলেন, ‘মহারাজ! মরিবার সময় রোগী ঔষধ খাইতে চাহে না, আমার কথাও হয়তো আপনার ভালো লাগবে না। দুর্যোধন যে মারা যাইবার জোগাড় করিতেছে, তাহা কি আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না? পাণ্ডবেরা একবাব ক্ষেপিয়া দাঁড়াইলে ছেলেপিলে চাকরবাকর সুদ্ধ যমের বাড়ি যাইতে হইবে। এই বেলা দুর্যোধনকে সাজা দিয়া পাণ্ডবদিগকে তুষ্ট করুন। একে তো পাশা খেলায় এত দোষ, তাহাতে শকুনি, এমন জুয়াচোর, উহাকে শীঘ্র চলিয়া যাইতে বলুন৷’

 এ কথায় দুর্যোধন ক্রোধভরে বিদুরকে গালি দিতে আরম্ভ করিলে বিদুর বলিলেন, ‘তোমাদের ভালোর জন্যই দুটো কথা বলিয়াছিলাম। দেখিতেছি তাহা তোমার পছন্দ হয় নাই। কাজ কি বাপু, তোমার যাহা খুশি তাহাই কর। তোমাকে নমস্কাব৷’

 কাজেই আবার খেলা চলিল। যে মহাবাজ যুধিষ্ঠিরেব মতো বিদ্বান, বুদ্ধিমান, আব ধার্মিক এই পৃথিবীতে ছিল না, সেই যুধিষ্ঠির পাশার ধাঁধায় পড়িয়া শেষে অবোধ মাতালেব মতো কাজ করিতে লাগিলেন৷

 ধন গেলে গাই বাছুর, তারপর লোকজন, তারপব রাজ্য। এইরূপে সর্বস্ব হারিযা ফকির হইয়াও চৈতন্য নাই। শেষে একটি-একটি করিয়া ভাইদিগকে হারিতে লাগিলেন।

 কি দুর্দশা! শেষে শকুনিই তাঁহাকে বিদ্রুপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘পাশা খেলিতে গিয়া লোকে এমন পাগলামি করিতে পারে, এ কথা তো স্বপ্নেও জানিতাম না।’

 কিন্তু ইহাতেও যুধিষ্ঠিরের দুর্গতির শেষ হয় নাই। ভাইগিকে হারিয়া শেষে নিজেকে পর্যন্ত হারিলেন, তথাপি তাহার জেদ থামে না৷

 ভাবিতেও দুঃখ আর লজ্জা হয়, যখন আর কিছুই অবশিষ্ট রহিল না তখন দয়া, ধর্ম, সদাচার সকল ভুলিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘এবার দ্রৌপদীকে পণ রাখিলাম৷’

 এ কথা শুনিবামাত্র সভার লোক ‘ছি! ছি!’ করিয়া উঠিল, রাজাগণের চোখে জল আসিল, লাজে দুঃখে আর অপমানে ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপের শরীর ঘামিয়া গেল, বিদুর হেঁট মুখে বসিয়া সাপের মতন নিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন৷

 ভালোলোকেদের মনে এইরূপ কষ্ট আর নির্লজ্জ ধৃতরাষ্ট্র আনন্দে অস্থির হইয়া বার বার জিজ্ঞাসা করিতেছো, ‘জয় হইল নাকি? জয় হইল নাকি?’

 কর্ণ, দুঃশাসন প্রভৃতি তখন কিরূপ আনন্দ করিতেছিলেন তাহা ধৃতরাষ্ট্রের ব্যবহারেই বুঝিতে পার।

 ধূর্ত শকুনি যখন পাশা ফেলিয়া দ্রৌপদীকে অবধি জিতিয়া লইলেন অমনি দুর্যোধন