পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

পথের লোক এমন সুন্দর মানুষ আর কখনো দেখে নাই। তাহারা আশ্চর্য হইয়া তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করে, তিনি বলেন, ‘আমি সৈরিন্ধ্রী, কাজ খুঁজিতেছি৷’ কিন্তু তাঁহার এ কথা কেহ বিশ্বাস করে না৷

 রানী সুদেষ্ণাও ছাদ হইতে দ্রৌপদীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি তাহাকে ডাকাইয়া পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন৷

 দ্রৌপদী বলিলেন, আমার স্বামী পাঁচজন গন্ধর্ব। কোনো কারণে তাঁহারা এখন বড়ই দুঃখে পড়িয়াছে, আর আমি সৈরিন্ধ্রীর কাজ করিয়া দিন কাটাইতেছি। আগে আমি সত্যভামা আর দ্রৌপদীর নিকট কাজ করিয়াছিলাম। এখন আপনার নিকট আসিয়াছি, দয়া করিয়া আশ্রয় দিলে এখানে থাকিব৷

 সুদেষ্ণা আহ্লাদের সহিত দ্রৌপদীকে সৈরিন্ধ্রীর কাজে নিযুক্ত করিলেন। দ্রৌপদী বলিলেন, মা, আমি কখনো উচ্ছিষ্ট ছুঁই না, বা কোনো নীচ কাজ করি না। আমার গন্ধর্ব স্বামীরা যদিও দুঃখে পড়িয়াছে, তবুও তাঁহারা আমাকে সর্বদা রক্ষা করেন। কেহ আমার অপমান করিলে, তাঁহারা তাহাকে মারিয়া ফেলেন৷

 এইরূপে ক্রমে অর্জুন, সহদেব আর নকুল এক-একজন করিয়া বিরাট রাজার নিকট কাজ লইলেন। অর্জুন হইলেন রাজকুমারী উত্তরার গানের শিক্ষক। সহদেব আর নকুল হইলেন গোশাল আর ঘোড়াশালের কর্তা। অর্জুন এখন স্ত্রীলোকের মতন পোশাক পরেন, আর বাড়ির ভিতরেই থাকেন। ভীমও তাঁহার কাজ সাবিয়া রান্নার মহলের বাহিরে আসিবার অবসর পান না। কাজেই তাঁহাদের কথা কেহ জানিতেও পারিল না৷

 এইরূপে দিন যায়। পাণ্ডবদের কাজ দেখিয়া বিরাট তাঁহাদের সকলের উপরেই বিশেষ সন্তুষ্ট। ভীম ইহার মধ্যেই জীমূত নামক একটা পালোয়ানকে হারাইয়া রাজার নিকট অনেক পুরস্কার পাইয়াছে। সুতরাং মোটের উপরে তাহাবা সুখেই আছে বলিতে হইবে৷

 কিন্তু হায়! দ্রৌপদীর সময় নিতান্তই কষ্টে কাটিতে লাগিল। সুদেষ্ণা তাঁহাকে খুবই স্নেহ করিতেন, কিন্তু সুদেষ্ণার ভাই কীচক তাঁহাকে দেখিতে পাইলেই অপমান করিত। দ্রৌপদী তাহা সহিতে না পারিয়া তাহাকে কত গালি দিতেন, কত মিনতি করিতেন, কত ভয় দেখাইতেন। দুরাত্মা তথাপি আরো বেশি করিয়া তাঁহাকে অপমান করিত৷

 একদিন সুদেষ্ণা কিছু খাবার আনিবার জন্য দ্রৌপদীকে কীচকের বাড়িতে পাঠান। সেদিন তাঁহার প্রতি সে এত অভদ্রতা করে যে, তিনি রাগ থামাইতে না পারিয়া তাহাকে ধাক্কা মারিয়া ফেলিয়া দেন। তারপর ভয়ে তিনি ছুটিয়া একেবারে রাজসভায় গিয়া উপস্থিত হন৷

 পাপিষ্ঠ সেইখানে তাঁহার পিছু পিছু ছুটিয়া গিয়া, তাঁহার চুলের মুঠি ধরিয়া তাঁহাকে মাটিতে ফেলিয়া, তাঁহার গায়ে লাথি মারিল। সেখানে যুধিষ্ঠির আর ভীম উপস্থিত ছিলেন, তাহাদের মনে ইহাতে কি ভয়ানক ক্লেশ হইল বুঝিতে পার। ভীম রাগে কাঁপতে কাঁপতে ক্রমাগত একটা গাছের দিকে তাকাইতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠির দেখিলেন সর্বনাশ উপস্থিত। ভীম হয়তো তখন ঐ গাছ লইয়া সভার সকলকে গুঁড়া করিবেন। তাই তিনি ভীমকে শান্ত হইতে ইঙ্গিত করিয়া বলিলেন, “কি পাচক ঠাকুর, কাঠের জন্য গাছের দিকে তাকাইতেছ? কাঠের গাছ বাহিরে গিয়া খোঁজ৷”