পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
২৫৯

জুড়াইয়া যাইবে।”

 কর্ণ বলিলেন, “কৃষ্ণ! তোমার সকল কথাই সত্য। কিন্তু তুমি আমাকে কি মনে করিয়াছ? দুর্যোধনের অনুগ্রহে আমি রাজ্য পাইয়া সুখে বাস করিতেছি। এই দুর্যোধনকে আমার ভরসায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করিয়া দিয়া, আমি তাহাকে ছাড়িয়া যাইব? লোকে তো জানে, আমি অধিরথ সারথির পুত্র। এখন যুদ্ধের আরম্ভেই যদি আমি পাণ্ডবদিগের সহিত মিলিতে যাই, তবে সকলে বলিবে আমি কাপুরুষ। না কৃষ্ণ! তোমার কথা আমি রাখিতে পারিব না!”

 বনবাসে যাইবার সময় কুন্তীকে পাণ্ডবেরা বিদুরের বাড়িতেই রাখিয়া যান। কৃষ্ণও যুদ্ধ থামাইবার চেষ্টায় আসিয়া এবারে বিদুরের বাড়িতেই ছিলেন। কাজেই তাহার নিকট কুন্তীর কোনো কথাই জানিতে বাকি থাকে নাই৷

 কৃষ্ণ চলিয়া যাইবার পবে, যুদ্ধের কথা ভাবিয়া কুন্তীর প্রাণে বড়ই ক্লেশ হইতে লাগিল। পুত্রগণ যুদ্ধ করিয়া একজন আর একজনকে মারিবে, মার প্রাণে একথা কি সহ্য হইতে পারে? তাই তিনি মনে করিলেন তিনি নিজে একবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন৷

 কর্ণ রোজ গঙ্গায় স্নান করিয়া সূর্যের স্তব করিতেন। স্নানের সময় কুন্তী গঙ্গার ধারে গিয়া, এই স্তবের শব্দে তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিলেন, এবং তাহারই ছায়ায় বসিয়া, স্তব শেষ হইবার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। স্তবের শেষে কর্ণ তাহাকে নমস্কার করিয়া জোড়হাতে কহিলেন, “হে দেবি, আমি অধিরথ এবং রাধার পুত্র কর্ণ, আপনাকে নমস্কার করিতেছি। আপনার কি চাহি?”

 কুন্তী বলিলেন, “বাছা, তুমি আমারই পুত্র। রাধার পুত্র তুমি কখনই নহ, সারথির ঘরে তোমার জন্মও হয় নাই। নিজের ভাইদিগকে না চিনিতে পারিয়া, কেন বাবা তুমি দুর্যোধনের সেবা করিতেছ? তোমার ভাইদের কাছে তুমি আইস। যেমন কৃষ্ণ বলরাম দুভাই, তেমনি আমার কর্ণ আর অর্জুন হউক। পাঁচ ভাইয়ের প্রভু হইয়া সুখে রাজ্য কর। সারথির পুত্র বলিয়া যেন তোমার দুর্নাম না থাকে৷”

 এ কথায় কর্ণ বলিলেন, “আপনার কথায় আমার শ্রদ্ধা হইতেছে না। জন্মকালে আপনি আমাকে ফেলিয়া দিয়াছিলেন; মায়েব কাজ আমার প্রতি কিছুই করেন নাই। এখন যে আমাকে স্নেহ দেখাইতেছে, তাহাও কেবল আপনার পুত্রদিগের উপকারের জন্য। এমন অবস্থায়, আমি আপনার কথায় দুর্যোধনকে ছাড়িতে যাইব কেন? তবে, আপনি কষ্ট করিয়া আসিয়াছেন, তাই এই পর্যন্ত বলিতে পারি যে, যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব ইহাদেব কাহারো আমি কোনো অনিষ্ট করিব না। কিন্তু অর্জুনকে ছাড়িতে আমি কিছুতেই প্রস্তুত নহি। যুদ্ধে হয় আমি তাহাকে মারিব, না হয় সে আমাকে মাবিবে। আপনার পাঁচ পুত্রই লোকে জানে, তাহার অধিক পুত্র আপনার থাকা ভালো নহে৷”

 এই বলিয়া কর্ণ সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। কুন্তীও কাঁদিতে কাঁদিতে ঘরে ফিরিলেন৷

 যুদ্ধ আর কিছুতেই থামিল না। সুতরাং তাহার আয়োজন বিধিমতে হইতে লাগিল। কুরুক্ষেত্রের প্রকাণ্ড মাঠের ভিতর দিয়া হিরণ্ববতী নদী বহিতেছে। সেই নদীর ধারে যুধিষ্ঠির তাহার সৈন্য সাজাইতে লাগিলেন। দুর্যোধনের লোকেরাও তাহারই সামনে আসিয়া শিবির প্রস্তুত করিল। দেখিতে দেখিতে সেই মাঠের চেহারা এমনি বদলাইয়া গেল যে, তাহাকে চেনা ভার। খাল পুকুর, রাস্তা, তাঁবু ইত্যাদিতে সে মাঠ নগরের মতো হইয়া গিয়াছে। তাহার