পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
২৭৯

 সুতরাং চিকিৎসকেরা তাহাদের ঔষধ লইয়া ফিরিয়া গেল। তারপর রাত্রি হইলে সে স্থানে প্রহরী রাখিয়া সকলে শিবিরে গমন করিলেন।

 রাত্রি প্রভাত হইলে, পুনরায় সকলে ভীষ্মের নিকট আসিয়া তাহাকে নমস্কার করিলেন। ক্রমে স্ত্রী, বালক, বৃদ্ধ সকলে তাহাকে দেখিবার নিমিত্ত সেখানে আসিতে লাগিল। কন্যাগণ তাহার উপরে ফুলের মালা চন্দনচুর্ণ ও খই ছড়াইতে লাগিল। গায়ক নর্তক ও বাদ্যকরগণ সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজারা বিনীতভাবে তাহার চারিদিক ঘিরিয়া বসিলেন। তখন সেখানকার শোভা হইল যেন স্বর্গের শোভা।

 এমন সময় ভীষ্ম বলিলেন, “জল দাও।”

 অমনি সকলে ব্যস্ত হইয়া নানারূপ মিষ্টান্ন এবং সুশীতল জল আনিয়া উপস্থিত করিল। তাহা দেখিয়া ভীষ্ম কহিলেন, “এ পৃথিবী হইতে আমি বিদায় লইয়াছি সুতরাং এখানকার মানুষেরা যে জল খায় আমি আর তাহা খাইব না। অর্জুন কোথায়?”

 অর্জুন জোড়হাতে বলিলেন, “কি করিতে হইবে দাদামহাশয়?”

 ভীষ্ম বলিলেন, “দাদা! বিছানা দিয়াছ, বালিশ দিয়াছ এখন তাহার উপযুক্ত জল দাও।”

 অর্জুন ভীষ্মের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, অমনি গাণ্ডীবে পর্জনাস্ত্র যোজনা করিলেন। সে অস্ত্র ভীষ্মের দক্ষিণ পার্শ্বের ভূমিতে নিক্ষেপ করামাত্রই, তথা হইতে অতি পবিত্র নির্মল জলের উৎস উঠিতে লাগিল। আহা, কি সুগন্ধ! কি মধুর শীতল জল! সে জল পান করিয়া ভীষ্মের প্রাণ জুড়াইল। তিনি অর্জুনকে বার বার আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “তোমার সমান ধনুর্দ্ধর এ জগতে আর নাই। দুর্যোধন আমাদের কথা শুনিল না; সুতরাং সে নিশ্চয় মারা যাইবে।”

 দুর্যোধন কাছেই ছিলেন, আর ভীষ্মের কথা শুনিয়া অতিশয় দুঃখিতও হইয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া ভীষ্ম বলিলেন, “দুর্যোধন! অর্জুন যাহা করিল, দেখিলে তো? এমন কাজ আর কেহই করিতে পারে না। এই পৃথিবীতে অর্জুন আর কৃষ্ণ ভিন্ন আগ্নেয়, বরুণ, সৌম্য, বায়ব্য, বৈষ্ণব, ঐন্দ্র, পাশুপত, পারমেষ্ট, প্রাজাপত্য, ধাত্র, কাষ্ট্র, সাবিত্র ও বৈবস্বত অস্ত্র সকলের কথা কেহ জানেন না। তুমি এইবেলা পাণ্ডবদিগের সহিত সন্ধি কর, আমার মৃত্যুতেই এই যুদ্ধের শেষ হউক। আমি সত্য কহিতেছি আমার কথা না শুনিলে নষ্ট হইবে।”

 এই কথা বলিয়া ভীষ্ম চুপ করিলেন; সকলে শিবিরে চলিয়া গেলেন। এমন সময় কর্ণ সেখানে আসিয়া ভীষ্মকে প্রণাম করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে প্রতিদিন আপনার দৃষ্টিপথে পড়িয়া আপনাকে ক্লেশ দিত, আমি সেই রাধেয় (রাধার পুত্র)।”

 ভীষ্ম কষ্টে চক্ষু মেলিয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, সেখানে অপর লোক নাই, কেবল প্রহরীরা আছে॥ তখন প্রহরীদিগকে সরাইয়া দিয়া এক হাতে কর্ণকে আলিঙ্গনপূর্বক তিনি বলিলেন, “কর্ণ। তুমি আসিয়া ভালো করিয়াছ। আমি নারদ আর ব্যাসের মুখে শুনিয়াছি, তুমি রাধার পুত্র নহ, তুমি কুন্তীর পুত্র। তুমি দুষ্টের দলে জুটিয়া পাণ্ডবদিগের নিন্দা করিতে, তাই আমি তোমাকে কঠিন কথা কহিতাম; কিন্তু আমি কখনো তোমার মন্দ ভাবি নাই। তোমার মতন ধার্মিক, দাতা, আর বীর এ পৃথিবীতে নাই এ কথা আমি জানি। এখন তুমি তোমার ভাইদিগের সহিত মিলিয়া থাক; আমার মৃত্যুতেই এই যুদ্ধ শেষ হইয়া যাউক।”

 কিন্তু এ কথায় কর্ণের মন ফিরিল না। তিনি বলিলেন, “পাণ্ডবদের সহিত আমার শত্রুতা