পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৮৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 দ্রোণের কাছে এত সময় নষ্ট করিলে তাহার চলিবে কেন? কাজেই তিনি হঠাৎ তাহার পাশ দিয়া রথ চালাইয়া দিলেন। তাহাতে দ্রোণ বলিলেন, “সে কি অর্জুন! তুমি না শত্রুকে জয় না করিয়া ছাড় না?” অর্জুন বলিলেন, “আপনি তো আমার শত্রু নহে, আপনি আমার গুরু! আমি আপনার পুত্রের সমান শিষ্য। আর আপনাকে কে যুদ্ধে হারাইতে পারে?”

 কিন্তু বুড়া কি সহজে ছাড়িবার লোক? তিনি অর্জুনের পশ্চাতে তাড়া করিলেন, তখন কাজেই অল্প স্বল্প করিয়া তাহাকে বারণ করা আবশ্যক হইল। এরপর ভোজকে পার হইতে হইবে। কিন্তু কৃতবর্মা ইহার মধ্যে পথ আটকাইয়া বসিয়াছে। যাহা হউক, ইহাকে অজ্ঞান করিতে অর্জুনের অধিক সময় লাগিল না।

 কৃতবর্মা অজ্ঞান হইলে আসিলেন শ্রতায়ুধ। ইহার বরুণদত্ত একটা ভয়ংকর গদা আছে। সে গদা কেহই ফিরাইতে পারে না। কিন্তু উহার একটি দোষ এই যে, যুদ্ধে লিপ্ত নহে এমন লোককে মারিলে, উহা উল্টিয়া তাহার প্রভুরই মাথায় পড়ে। শ্রতায়ুধ অর্জুনকে মারিতে গিয়া, সেই গদা কৃষ্ণের উপর ঝাড়িয়া বসিয়াছে! কাজেই, বুঝিতেই পার, অর্জুনের আর শতায়ুধকে মারিবার জন্য পরিশ্রম করিতে হইল না।

 শ্রতায়ুধের পর সুদক্ষিণ; তারপর শতায়ু ও অচ্যুত; তারপর উহাদিগের পুত্র নিয়তায়ু, দীর্ঘায়ু:তারপর সহস্র সহস্র অঙ্গদেশীয় গজারোহী সৈন্য; তারপর বিকটাকার অসংখ্য যবন, পারদ ও শক; তারপর আর-একজন শ্রুতায়ু—এইরূপ করিয়া কত যোদ্ধা মরিল। দুর্যোধন তো দ্রোণের উপর চটিয়াই অস্থির! তিনি বলিলেন, “আপনি আমাদের খান, আবার আমাদেরই অনিষ্ট করেন। আপনি যে মধু মাখানো ক্ষুরের মতো, তাহা আমি জানিতাম না। যাহা হউক, শীঘ্র জয়দ্রথকে বাচাইবার উপায় করুন।”

 দ্রোণ বলিলেন, “আমি কি করিব? আমি বুড়া হইয়া এখন আর ছুটাছুটি করিতে পারি না। অর্জুন একটু ফাক পাইলেই রথ হাঁকাইয়া চলিয়া যায়। কৃষ্ণ এমনি তাড়াতাড়ি রথ চালান যে অর্জুনের বাণ তাহার এক ক্রোশ পিছনে পড়ে। অস্ত্রহাতে ইন্দ্র আসিলেও আমি তাহাকে পরাজয় করিতে পারি, কিন্তু অর্জুনকে পরাজয় করিতে কিছুতেই পারিব না। তুমিই হয় অনেক লোক লইয়া, একবার তাহার সহিত যুদ্ধ করিয়া, দেখ না। আমি তোমার গায়ে এক আশ্চর্য কবচ বাধিয়া দিতেছি ইহাকে কোনো অস্ত্রই ভেদ করিতে পারিবে না।”

 এই বলিয়া দ্রোণাচার্য, জল ছুঁইয়া মন্ত্র পড়িতে পড়িতে, দুর্যোধনের গায়ে সেই অদ্ভুত উজ্জল কবচ বাধিয়া দিলে, দুর্যোধন মহোৎসাহে অর্জুনকে মারিতে চলিলেন।

 এই সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষের যোদ্ধারা, অনেক সৈন্য লইয়া, দ্রোণকে ভয়ংকর তেজের সহিত আক্রমণ করাতে তাহার সৈন্যসকল তিন দলে ভাগ হইয়া গেল। দ্রোণ অনেক চেষ্টা করিয়াও আর তাহাদিগকে একত্র করিতে পারিলেন না। তখন কি ঘোর যুদ্ধই হইয়াছিল। অশ্বত্থামা, কর্ণ, সৌমদত্ত প্রভৃতি কয়েকজন বড়বড় বীরের হাতে, সকল সৈন্যের পশ্চাতে জয়দ্রথকে রাখিয়া, আর প্রায় সকলেই যুদ্ধে লাগিয়া গিয়াছিলেন। কত যে লোক মরিয়াছিল তাহার গণনা নাই। দ্রোণাচার্যের সহিত ধৃষ্টদ্যুম্ন এই সময়ে খুব যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু সাত্যকি আসিয়া সাহয্য না করিলে, বুড়ার হতে তাহার বড়ই দুর্দশা হইত। সাত্যকি দেখিলেন যে, দ্রোণ ধূমের খড়্গ, চর্ম, ধ্বজ, ছত্র, ঘোড়া সারথি সমুদায় শেষ করিয়া এক সাংঘাতিক বাণ চড়াইয়া বসিয়াছে। সেই বাণ ছুড়িবামাত্র সাত্যকি চৌদ্দ বাণে তাহা