পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 দ্রোণ আর অর্জুনের যুদ্ধ কি আশ্চর্য, তাঁহাদের হাতেরই বা কি অদ্ভুত ক্ষমতা, রথেরই বা কি বিচিত্র গতি, আর অস্ত্রেরই বা কি চমৎকার গুণ। কত বড়-বড় অস্ত্র যে দ্রোণ অর্জুনকে মারিলেন, তাহার সংখ্যা নাই। অর্জুন তাহা সকলই কাটিয়া ফেলিলেন। যতই তিনি সে সব অস্ত্র কাটেন, দ্রোণ ততই আহ্লাদিত হইয়া ভাবেন যে, ‘আমি যত পরিশ্রম করিয়া উহাকে শিখাইয়াছিলাম, তাহা সার্থক হইয়াছে।’

 সেদিন অনেকের সহিত অনেকের যুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু দ্রোণ যেমন তেজের সহিত পাণ্ডব সৈন্য সংহার করিয়াছিলেন, পাণ্ডবেরা তেমন করিয়া কৌরব সৈন্য মারিতে পারেন নাই। দ্রোণের পরাক্রম দেখিয়া তাঁহাদের মনে আতঙ্ক উপস্থিত হইল।

 এমন সময় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “অর্জুন! দ্রোণের হাতে অস্ত্র থাকিতে দেবতারাও উহাকে মারিতে পারেন না। অতএব যাহাতে উনি অস্ত্র ছাড়েন, তাহার উপায় করিতে হইবে। কেহ গিয়া উহার কাছে বলুক যে, “অশ্বত্থামা মরিয়া গিয়াছে’ তাহা হইলে উনি অস্ত্র ছাড়িয়া দিবেন।”

 অর্জুন এমন কাজ করিতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না, কিন্তু অন্য যোদ্ধারা ইহাতে মত দিলেন, এবং অনেক কষ্টে যুধিষ্ঠিরেরও মত করানো হইল।

 তখন ভীম কি করিলেন শুন। পাণ্ডবপক্ষের ইন্দ্রবর্মার একটা হাতি ছিল, তাহার নাম ‘অশ্বত্থামা’! ভীম গদাঘাতে সেই হাতিটাকে মারিয়া, লজ্জিতভাবে দ্রোণের নিকট আসিয়া চিৎকারপূর্বক বলিতে লাগিলেন, “অশ্বত্থামা মরিয়া গিয়াছে। অশ্বত্থামা মরিয়া গিয়াছে!”

 এ কথায় দ্রোণ প্রথমে বড়ই কাতর হইলেন; কিন্তু তারপর মনে করিলেন যে ‘অশ্বত্থামা অমর, সে কি মরিয়া যাইবে? তারপর খানিক যুদ্ধ করিয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যুধিষ্ঠির! অশ্বত্থামা মরিছে এ কথা কি সত্য?”

 দ্রোণ জানেন যে, যুধিষ্ঠির কখনোই মিথ্যা কথা কহেন না, কাজেই তিনি যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন। কিন্তু হায়! কৃষ্ণ যে ইহার মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে কি শিখাইয়া রাখিয়াছে, তাহা তিনি জানেন না। কৃষ্ণ তাহাকে বলিয়াছেন, “মহারাজ! আপনি এই মিথ্যা কথাটুকু না বলিলে, আমরা সকলে আজ দ্রোণের হাতে মারা যাইব। সুতরাং এইটুকু মিথ্যা কথা বলিয়া আমাদিগকে রক্ষা করুন।”

 ইহার উপর আবার ভীম সেই অশ্বত্থামা নামক হাতিটাকে মারিয়া অশ্বথামা মরিয়াছে একথা বলার সুবিধাও করিয়া দিয়াছে। কাজেই যুধিষ্ঠিরের আর তাহা বলিতে তত আপত্তি নাই। তবে কথা এই যে, দ্রোণ তো আর হাতির কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই, তিনি তাঁহার পুত্রের কথাই জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। সুতরাং কেবল ‘অশ্বত্থামা মরিয়াছে’, এ কথা তাঁহাকে বলিলে মিথ্যা কথাই বলা হয় বৈকি!

 যাহা হউক, যুধিষ্ঠিরের চেষ্টা, যাহাতে দুই দিকই রক্ষা হয়। জয়ও লাভ করিতে হইবে, মিথ্যাও বলা হইবে না। এই ভাবিয়া তিনি দ্রোণকে বলিলেন, “অশ্বত্থামা মরিয়াছে...হাতি।”

 ‘অশ্বথামা মরিয়াছে’ এইকথাগুলি বলিলেন জোরে, দ্রোণ তাহাই শুনিতে পাইলেন। ‘হাতি’ কথাটি বলিলেন অতি মৃদু স্বরে; দ্রোণ তাহা শুনিতে পাইলেন না।

 মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রথ কখনো মাটি ছুঁইত না, সর্বদাই চারি আঙ্গুল উচ্চে থাকিত। কিন্তু তিনি মিথ্যা কথা বলার পর হইতে, তাহা মাটিতে নামিয়া পড়িল।