পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
৩১৭

 এই সময়ে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “আপনি কোন সাহসে দুর্যোধনকে আপনাদের যাহার সহিত ইচ্ছা যুদ্ধ করিতে বলিলেন? দুরাত্মা যদি আপনাকে, অর্জুনকে,নকুলকে বা সহদেবকে আক্রমণ করিয়া বসিত, তাহা হইলে আপনাদের কিরূপ দশা হইত? ভীমও গদাযুদ্ধে দুর্যোধনকে আঁটিতে পারে কিনা সন্দেহ। ভীমের বল আর তেজ বেশি, কিন্তু দুর্যোধনের শিক্ষা অধিক, আর শিক্ষাতেই হারজিৎ। এখন বুঝিলাম যে, পাণ্ডবদের কপালে রাজ্য লাভ নাই, বিধাতা উহাদিগকে বনে থাকিবার জন্যই সৃষ্টি করিয়াছেন।”

 এমন সময় ভীম গদা হাতে লইয়া দুর্যোধনকে বলিলেন, “ওরে নরাধম! সকল দুরাত্মা মরিয়া এখন কেবল তুমিই অবশিষ্ট রহিয়াছ; আজ এই গদার প্রহারে তোমাকেও বধ করিয়া, আমাদের সকল দুঃখের শোধ লইব!”

 দুর্যোধন বলিলেন, “আর বড়াই করিও না! এখনি তোমার যুদ্ধের সাধ মিটাইয়া দিব।ন্যায় মতে গদাযুদ্ধে ইন্দ্রও আমাকে পরাজয় করিতে পারেন না। আইস দেখি, তোমার কত বিদ্যা!”

 দুজনে প্রাণ ভরিয়া গালাগালি চলিতেছে, এমন সময় বলরাম সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভীম ও দুর্যোধন দুইজনেই বলরামের ছত্র, তিনিই ইহাদের গদা শিক্ষার গুরু। সুতরাং যুদ্ধের সময় তাহাকে উপস্থিত দেখিয়া দুজনেরই খুব উৎসাহ হইল।

 কুরুক্ষেত্র অতি পবিত্র স্থান, সেখানে মৃত্যু হইলে স্বর্গলাভ হয়। এইজন্য বলরাম বলিলেন যে, যুদ্ধ দ্বৈপায়ণ হ্রদের ধারে না হইয়া কুরুক্ষেত্রে হওয়াই ভালো। তখন সকলে সেখান হইতে কুরুক্ষেত্রে আসিয়া, যুদ্ধের জন্য একটি স্থান দেখিয়া লইলেন।

 তারপর দুজনে, দুই মত্ত হস্তীর ন্যায় গর্জন করিতে করিতে, কি ঘোর যুদ্ধই আরম্ভ করিলেন। সকলে স্তব্ধভাবে চারিদিকে বসিয়া সেই অদ্ভুত যুদ্ধ দেখিতে লাগিল।

 সেকালের লোকেরা আগে খুব এক চোট বাক্য যুদ্ধ, অর্থাৎ গালাগালি, না করিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিত না। সুতরাং প্রথমে তাহাই কিছুকাল চলিল। তারপর ভীষণ ঠকঠক শব্দে রণস্থল কাঁপাইয়া উভয়ে উভয়কে আঘাত করিতে লাগিলেন। সে সময়ে তাহাদের গদা হইতে ক্রমাগত আগুন বাহির হইতেছিল।

 সে যুদ্ধের কি অদ্ভুত কৌশল! মণ্ডল, গতি, প্রত্যাগতি, অস্ত্র, যন্ত্র, পরিমোক্ষ, প্রহার, বঞ্জন, পরিবারণ, অভিস্রাবণ, আক্ষেপ, বিগ্রহ, পরাবর্তন, সংবর্ধন, অবপ্লুত, উপপুত, উপন্যস্ত প্রভৃতি অশেষ প্রকার কৌশল দেখাইয়া তাহারা যুদ্ধ করিয়াছিলেন। এ সকল কৌশলে দুর্যোধনেরই অধিক ক্ষমতা দেখা গেল। তিনি একবার ভীমের বুকে এমনি গদা প্রহার করিলেন যে, কিছুকাল পর্যন্ত তাহার নড়িবার শক্তি রহিল না। যাহা হউক, ইহার পরেই ভীমও, এক গদাঘাতে দুর্যোধনকে অজ্ঞান করিলেন।

 খানিক পরে দুর্যোধন উঠিয়াই, ভীমের কপালে এমন গদার আঘাত করিলেন যে, সে স্থান হইতে দর দর ধারে রক্ত পড়িতে লাগিল। কিন্তু ভীমের দেহে এমনি অসাধারণ শক্তি ছিল যে, সেই সাংঘাতিক আঘাতেও তাহার কিছুই হইল না। তাহার পরেই দেখা গেল যে, দুর্যোধন ভীমের গদার চোটে ঘুরিতে ঘুরিতে পড়িয়া যাইতেছে। তখনি আবার দুর্যোধনের আঘাতে ভীমেরও সেই দশা হইল! তখন দুর্যোধন ঘোরনাদে পুনরায় গদাঘাত করত ভীমের কবচ ছিড়িয়া দিলেন। সে আঘাতের বেগ ভীম সহজে সামলাইতে পারিলেন না।

 এতক্ষণে কৃষ্ণ স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে, ন্যায় যুদ্ধে ভীমের দুর্যোধনকে পরাজয় করা অসম্ভব। সুতরাং তিনি অন্যায় যুদ্ধেই তাহাকে বধ করিতে পরামর্শ দিলেন। তখন অর্জুন ইঙ্গিত