পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
৩২১

ধরিয়া মাটিতে আছড়াইতে লাগিলেন। তারপর তাঁহার গলা টিপিয়া ধরিয়া, বুকে লাথি মারিতে আরম্ভ করিলে, ধৃষ্টদ্যুম্ন অনেক কষ্টে বলিলেন, “আমাকে অস্ত্রাঘাতে শীঘ্র সংহার কর।” কিন্তু অশ্বত্থামা তাহা না শুনিয়া পদাঘাতে তাঁহার প্রাণ শেষ করিলেন।

 ধৃষ্টদ্যুম্নের চীৎকারে সকলে জাগিয়া উঠিয়া কোলাহল করিতে লাগিল। স্ত্রীলোকেরা কাঁদিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু সেই ভীষণ রাত্রে ঘুমের ঘোরে, বিষম ত্রাসে কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিল না, কি হইয়াছে।

 এদিকে অশ্বত্থামা অস্ত্র হাতে সাক্ষাৎ শমনের ন্যায় সকলকে সংহার করিতেছেন। যোদ্ধারা যুদ্ধ করিবে কি? একে রাত্রিকাল, তাহাতে নিদ্রাকালে হঠাৎ আক্রমণ;হতভাগ্যেরা ভালোমতে প্রস্তুত হওয়ার পূর্বেই অশ্বত্থামা তাহাদিগকে আক্রমণপূর্বক বধ করিতে লাগিলেন।

 সে নিষ্ঠুর নীচ ভীষণ কার্যের আর বর্ণনা করিয়া কি হইবে? শিবিরে যত লোক ছিল, স্ত্রীলোক ভিন্ন আর তাহাদের একজনও রক্ষা পাইল না। পাণ্ডবদিগের পুত্রকয়টিকে অবধি অশ্বত্থামা নির্দয়ভাবে বিনাশ করিলেন। তিনি চুপিচুপি চোরের ন্যায় প্রবেশ করিবার সময় শিবির যেমন নিস্তব্ধ ছিল, দেখিতে দেখিতে আবার তাহা সেইরূপ নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখন তিনি দেখিলেন যে, তাঁহার কার্য সম্পন্ন হইয়াছে, রাত্রিও শেষ হইয়াছে।

 তারপর বাহিরে আসিয়া, অশ্বত্থামা কৃপ এবং কৃতবর্মাকে নিজ কীর্তি শুনাইলেন, আর জানিতে পারিলেন যে, তাঁহারা উভয়ে মিলিয়া একটি প্রাণীকেও পলায়ন করিতে দেন নাই। তখন তিনজনে মনের আনন্দে করতালি দিয়া কোলাহল করিতে লাগিলেন। এমন কাজের সংবাদটা দুর্যোধনকে তখন জানানো চাই:সুতরাং তাঁহারা তাঁহার নিকট আসিতে আর তিলমাত্র বিলম্ব করিলেন না।

 হায় মহারাজ দুর্যোধন! এখন তিনি কি করিতেছেন? এখনো তিনি মৃত্যুর অপেক্ষায় রণস্থলে শয়ান। প্রাণ বাহির হইতে বিলম্ব নাই, জ্ঞান লোপ হইয়া আসিতেছে, মুখ দিয়া ক্রমাগত রক্ত বাহির হইতেছে! বৃক প্রভৃতি ভয়ানক জন্তুগণ আসিয়া তাঁহার মাংসের লোভে তাঁহাকে ঘেরিয়াছে তিনি দারুণ যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে, অতি কষ্টে তাহাদিগকে বারণ করিতেছেন।

 তাঁহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া সেই তিন বীর আর চোখের জল থামাইয়া রাখিতে পারিলেন না। একাদশ অক্ষৌহিণীর যিনি অধিপতি ছিলেন, তাঁহার কিনা এই দশা! আর সেই বীরের মাংস খাইবার জন্য, বন্যজন্তুরা তাঁকে ঘেরিয়াছে! যাহা হউক, এসব কথা ভাবিয়া আর কি হইবে? এখন যে সংবাদ লইয়া তিনজন আসিয়াছিলেন তাহা তাঁহাকে শোনানো হউক। এই ভাবিয়া অশ্বথামা তাহাকে বলিলেন, “হে কুরুরাজ! যদি জীবিত থাকেন, তবে এই আনন্দের সংবাদ শ্রবণ করুন। এখন পাণ্ডব পক্ষে পাঁচ পাণ্ডব, কৃষ্ণ আর সাত্যকি এই সাতজনমাত্র জীবিত। আজ রাত্রে আমি তাহাদের শিবিরে প্রবেশ করিয়া, আর সকলকে বধ করিয়াছি।”

 এ কথায় দুর্যোধন চক্ষু মেলিয়া বলিলেন, “হে বীর! ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ যাহা করিতে পারেন নাই, আজ তুমি তাহা করিলে। তোমাদের কথা শুনিয়া নিজেকে ইন্দ্রের ন্যায় সুখী মনে করিতেছি। এখন তোমাদের মঙ্গল হউক; আবার স্বর্গে দেখা হইবে।” এই বলিয়া দুর্যোধন সেই তিনজনকে আলিঙ্গন করিলে, তাঁহার আত্মা দেহ ছাড়িয়া স্বর্গে চলিয়া গেল।

 ইহার কিঞ্চিৎ পরে সঞ্জয় কাদিতে কাদিতে এই সংবাদ লইয়া হস্তিনার উপস্থিত হইলেন।

উপেন্দ্র—৪১