পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

সেদিন আর তিনি অন্যদিনের মতো স্থিরভাবে তাঁহার কথা বলিতে পারিলেন না। ধৃতরাষ্ট্রের পুরীতে প্রবেশমাত্রই তিনি দুহাত তুলিয়া, ‘হা মহারাজ! হ মহারাজ!’ বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন। তারপর তাঁহার মুখে সেই দারুণ সংবাদ শুনিয়া, সকলের, বিশেষত ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর, যে অবস্থা হইল, তাহা বর্ণনাতীত। সে সংবাদে কেহ অজ্ঞান কেহ বা হতবুদ্ধি হইয়া গেল। অনেকে পাগলের ন্যায় ছুটাছুটি করিতে লাগিল। তারপর এমন কান্না আরম্ভ হইল যে, তাহা শুনিলে বুঝি পাথরও গলিয়া যায়।

 এদিকে রাত্রির সেই ভীষণ ব্যাপারের সংবাদ পাইয়া, পাণ্ডবগণের কিরূপ কষ্ট হইল, তাহা আর বলিয়া কি হইবে? নকুল তখনই দ্রৌপদীকে আনিতে পাঞ্চাল দেশে চলিয়া গেলেন। দ্রৌপদী আসিলে পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত এমনভাবে কাটিল যে, সে দুঃখের আর তুলনা নাই। দ্রৌপদী কাঁদিতে কাঁদিতে রাগে অস্থির হইয়া বলিলেন, “আজ যদি সেই পামরকে সংহার করা না হয়, তবে অনাহারে প্রাণত্যাগ করিব।”

 যুধিষ্ঠির তখন তাঁহাকে বুঝাইতে অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তিনি তাহাতে শান্ত না হইয়া বলিলেন, “শুনিয়াছি অশ্বত্থামার জন্মাবধি তাহার মাথায় একটা মণি আছে। ঐ দুরাত্মার প্রাণ বধপূর্বক সেই মণি আনিয়া দিতে পারিলে, আমি তাহা তোমাকে পরাইয়া কিঞ্চিৎ শান্ত হইতে পারি।”

  তিনি ভীমকেও বলিলেন, “অশ্বত্থামাকে মারিয়া এই মণি আনিয়া দিতে হইবে।” একথা বলামাত্রই ভীম নকুলকে সারথি করিয়া অশ্বত্থামার খোঁজে বাহির হইলেন। অশ্বথামার রথের চাকার দাগ স্পষ্টই দেখা যাইতেছিল, সুতরাং তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা তেমন কঠিন কাজ বলিয়াও বোধ হইল না।

 কিন্তু ভীমকে অশ্বথামার খোঁজে যাইতে দেখিয়া কৃষ্ণের বড়ই চিন্তা হইল। তিনি জানতেন যে অশ্বত্থামাকে দ্রোণ ব্রহ্মশির নামক অস্ত্র দিয়াছিলেন। উহা এমনই ভয়ংকর যে, তাহার বদলে অশ্বথামা কৃষ্ণের চক্র চাহিতেও লজ্জ্বাবোধ করেন নাই। অশ্বত্থামা রাগের ভরে ভীমের উপরে এই অস্ত্র মারিয়া বসিলে, তাঁহার রক্ষা থাকিবে না। সুতরাং কৃষ্ণ তখনই যুধিষ্ঠির আর অর্জুনকে লইয়া রথারোহণে ভীমের অনুগামী হইলেন। ভীমকে পাইতেও তাঁহাদের বিলম্ব হইল না। কিন্তু তিনি কি নিষেধ শুনিবার লোক? তিনি তাঁহাদের কথা না শুনিয়াই ছুটিয়া চলিলেন। তারপর গঙ্গার ধারে আসিয়া অশ্বত্থামাকে ব্যাসদেবের নিকট দেখিবামাত্র তিনি, “দাঁড়া বামুন, দাঁড়া!” বলিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে গেলেন।

 অশ্বথামা দেখিলেন বড়ই বিপদ। একা ভীম হইতেই রক্ষা নাই, তাহাতে আবার ভীমের পশ্চাতে কৃষ্ণ, অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরকেও দেখা যাইতেছে কাজেই তিনি তখন প্রাণভয়ে তাড়াতাড়ি “পাণ্ডব বংশ নষ্ট হউক।” বলিয়া, সেই ব্রহ্মশির অস্ত্র ছুঁড়িয়া বসিলেন। তখন সর্বনাশ উপস্থিত দেখিয়া, কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “শীঘ্র তোমার দ্রোণদত্ত সেই মহাঅস্ত্র ছাড়।”

 অর্জুন তৎক্ষণাৎ, “এই অস্ত্রে অশ্বথামার অস্ত্র বারণ হউক।” বলিয়া তাঁহার অস্ত্র ছড়িলেন। অমনি সেই দুই অস্ত্রের তেজে এমন ভয়ংকর গর্জন উল্কাবৃষ্টি আর বজ্রপাত আরম্ভ হইল যে, সকলে ভাবিল, বুঝি সৃষ্টি নষ্ট হয়।

 তখন নারদ আর ব্যাসদেব, সৃষ্টি রক্ষার জন্য, সেই দুই অস্ত্রের মাঝখানে দাঁড়াইয়া অর্জুন ও অশ্বথামাকে শীঘ্র তাঁহাদের অস্ত্র থামাইতে বলিলেন। অর্জুন বলিলেন, “অশ্বথামার অস্ত্র