পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৩০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 ধনরত্ন যাহা কিছু ছিল, যুদ্ধে প্রায় তাহার সমস্তই ব্যয় হইয়া গিয়াছে। এখন অশ্বমেধ যজ্ঞের উপযুক্ত ধন কোথায় পাওয়া যাইবে? যুধিষ্ঠিরের এইরূপ চিন্তা দেখিয়া ব্যাস তাঁহাকে বলিলেন, “বৎস, তুমি চিন্তা করিও না; ধন সহজেই পাওয়া যাইবে। পূর্বে মহারাজ মরুত্ত হিমালয় পর্বতে যজ্ঞ করিয়া, ব্রাহ্মণদিগকে এত অধিক সুবর্ণ দিয়াছিলেন যে, তাঁহারা তাহা বহিতে না পারিয়া সেইখানেই ফেলিয়া আসেন। সেই সুবর্ণ এখনো তথায় রহিয়াছে, তাহা আনিলে অনায়াসে তোমার যজ্ঞ হইতে পারে।”

 এ কথায় যুধিষ্ঠির হর্ষভরে অমাত্যগণের সহিত সেই ধন আনয়নের পরামর্শ করিতে লাগিলেন। ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব প্রভৃতি সকলেই বলিলেন, “ব্যাসদেবের পরামর্শ অতি উত্তম।” সুতরাং অবিলম্বে মরুত্তের যজ্ঞের সোনা আনিবার জন্য হিমালয় যাত্রার আয়োজন হইল। সেখানে গিয়া উহা খুঁজিয়া বাহির করিতেও বিশেষ ক্লেশ হইল না।

 সেকালের লোকে এত ধন কোথায় পাইত? আর না জানি তাহারা কিরূপ মহাশয় লোক ছিল যে, এত ধন দান করিত! মরুত্ত রাজার যজ্ঞের সেই সোনা আনিতে, ষাটলক্ষ উট, এক কোটি বিশ লক্ষ ঘোড়া, দুই লক্ষ হাতি, এক লক্ষ রথ, এক লক্ষ গাড়ি লাগিয়াছিল। আর মানুষ আর গাধা যে কত লাগিয়াছিল তাহার সংখ্যা নাই। এতগুলিতেও কি সে ধন সহজে আনিতে পারিয়াছিল? তাহারা সেই সোনার ভারে বাঁকা হইয়া, দিনে দুই ক্রোশের অধিক পথ চলিতে পারে নাই!

 এত ধন যে যজ্ঞে ব্যয় হইয়াছিল, তাহা যে কত বড় যজ্ঞ, বুঝিয়া লও। একটি প্রশস্ত ভূমি খাঁটি সোনায় মুড়িয়া, তাহার উপর যজ্ঞের গৃহাদি প্রস্তুত হইল। জমিটি যেমন, ঘর বাড়িও অবশ্য তাহার উপযুক্তই হইয়াছিল। এদিকে অর্জুন, ইহার অনেক পূর্বেই, গাণ্ডীব হাতে, একটি সুন্দর ঘোড়ার পশ্চাতে পৃথিবীর সকল স্থানে ঘুরিয়া আসিবে। ইহার মধ্যে কাহাকেও সে ঘোড়া আটকাইতে দেওয়া হইবে না। আর, অর্জুন যাহার রক্ষক, তাহাকে কেহ আটকাইয়া রাখিবার আশঙ্কাও নাই।

 অর্জুনের যাত্রাকালে যুধিষ্ঠির তাঁহাকে বলেন, “যাঁহারা কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করিয়াছিল, তাহাদের পুত্র পৌত্রদিগকে বধ করিও না।” অর্জুন যথাসাধ্য এই আজ্ঞা পালনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন; সেজন্য তাঁহাকে বিস্তর ক্লেশও পাইতে হইল। কুরুক্ষেত্রে কত রাজাই পাণ্ডবদিগের হতে মারা গিয়াছে, তাহাদের দেশে গেলেই, তাহাদের পুত্র পৌত্র আর দেশের লোকেরা ক্ষেপিয়া অর্জুনকে মারিতে আইসে। তিনি তাহাদিগকে অধিক বাণ মারেন না, পাছে বেচারারা মারা যায়। কিন্তু তাহাতে তাহারা মনে করে, বুঝি তিনি ভালোরূপ যুদ্ধই করিতে পারেন না; কাজেই তাহারা মহোৎসাহে তাহাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। সুতরাং তখন তিনি তাহাদের দু-চারজনকে মারিতে বাধ্য হন। তারপর তারা ভয়ে জড়সড় হইয়া তাঁহার নিকট হাতজোড় করিতে থাকে।