পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
৩৩১

 ত্রিগর্ত দেশে সুশর্মার পুত্র ধৃতবর্মার সহিত এইরূপ হইল। প্রাগ্‌জ্যোতিষে ভগদত্তের পুত্র বজ্রদত্তের সহিত এইরূপ হইল। সিন্ধুদেশে জয়দ্রথের আত্মীয়গণও এইরূপ আরম্ভ করিল। শেষে তাহাদের অত্যাচার অসহ্য হওয়ায় তিনি তাহাদের মাথা কাটিতে আরম্ভ করিলে আর তাহাদের দুর্দশার সীমা নাই।

 এমন সময় জয়দ্রথের স্ত্রী দুঃশলা, তাহার শিশু পৌত্রটিকে কোলে লইয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে অর্জুনের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দুঃশলা ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা, সুতরাং অর্জুনের ভগিনী। তাহাকে দেখিবামাত্র অর্জুন গাণ্ডীব রাখিয়া দিয়া বলিলেন, “ভগিনী। তোমার কি কাজ করিব, বল।”

 ইহার উত্তরে দুঃশলা যাহা বলিলেন, তাহাতে অর্জুনের মনে বড়ই ক্লেশ হইল! জয়দ্রথের সঙ্গে দুঃশলার বিবাহ হইয়াছিল। জয়দ্রথের মৃত্যুর পর তাহার পুত্র সুরথ, পিতার শোকে নিতান্ত কাতর হইয়া পড়েন। ইহার উপরে যখন তিনি শুনিলেন যে অর্জুন যজ্ঞের ঘোড়া সমেত আসিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছেন, তখনি তাঁহার মৃত্যু হইল। এখন দুঃখিনী বিধবা দুঃশলা, পতি পুত্রের শোকে অস্থির হইয়া, পৌত্রটিকে অর্জুনের নিকট উপস্থিত করিয়াছেন, যদি তাহাকে দেখিয়া অর্জুনের দয়া হয়।

 ছেলেটি যখন মাথা হেঁট করিয়া কাতরভাবে অর্জুনকে প্রণাম করিল, তখন আর তিনি চক্ষের জল না রাখিতে পারিয়া বলিলেন, “ক্ষত্রিয়ের ধর্মকে ধিক্! এই ধর্ম পালন করিতে গিয়াই বন্ধু-বান্ধবদিগকে বধ করিয়াছি!”

 এই বলিয়া তিনি দুঃশলাকে সাদর মধুর বাক্যে সান্ত্বনা দিয়া তথা হইতে বিদায় হইলেন।

 মণিপুরের রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদাকে অর্জুন বিবাহ করিয়াছিলেন। এখন সেই চিত্রাঙ্গদার পুত্র বভ্রুবাহণ মণিপুরের রাজা। ঘোড়া মণিপুরে উপস্থিত হইলে বভ্রুবাহণ তাঁহার পিতার আগমন সংবাদ প্রাপ্তিমাত্রেই পাত্রমিত্র সমেত, অতি বিনীতভাবে অর্জুনের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

 কিন্তু অর্জুন ইহাতে কিছুমাত্র সন্তুষ্ট হইলেন না। তিনি বভ্রুবাহণকে বলিলেন, “আমি আসিলাম যুদ্ধ করিতে, আর তুমি করজোড়ে আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলে! ইহা কখনোই ক্ষত্রিয়ের কাজ নহে, ইহা কাপুরুষের কাজ। তোমাকে ধিক্। তোমার জীবনে প্রয়োজন কি?”

 এ কথায় বভ্রুবাহণ নিতান্ত ব্যথিতচিত্তে মাথা হেঁট করিয়া রহিলেন। এমন সময় সেই যে উলুপী নাম্নী নাগকন্যার সহিত অর্জুনের বিবাহ হইয়াছিল, তিনি আসিয়া বভ্রুবাহণকে বলিলেন, “বাছা, আমি তোমার বিমাতা উলুপী। তোমার পিতা যখন যুদ্ধের বেশে আসিয়াছেন, তখন ইঁহার সহিত যুদ্ধ করাই তোমার উচিত। তাহাতে ইনি সন্তুষ্ট হইবেন।” তখন বভ্রুবাহণ, বিপুল যুদ্ধের আয়োজন করিয়া, সৈন্যগণকে আদেশ দিবামাত্রই তাহারা যুদ্ধ আরম্ভ করিলে, ক্ষণেকের ভিতরেই বভ্রুবাহণের বাণে তাঁহাকে অজ্ঞান হইতে হইল।

 জ্ঞান হইলে অর্জুন বভ্রুবাহণকে বলিলেন, “বাঃ! এই তো চাই! আমি বড়ই সন্তুষ্ট হইলাম! আচ্ছা, এখন আমি মারি, স্থির হইয়া সামলাও তো!”

 তারপর অর্জুন অসংখ্য নারাচ ছুঁড়িয়া মারিলে, বভ্রুবাহণ তাহার সমস্তই কাটিলেন! কিন্তু তাহার পরে ভয়ানক বাণগুলি ফিরাইতে না পারায়, তাহার রথের ধ্বজ আর ঘোড়া কাটা