পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৩২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

গেল। তখন তিনি রথ হইতে নামিয়া এমনি ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে, তাহা দেখিয়া অর্জুনের আর আনন্দের সীমা রহিল না। এমন সময় বভ্রুবাহণ কি যে একটা বাণ মারিলেন, তাহাতে নিমেষ মধ্যে অর্জুনকে একেবারে মৃতপ্রায় করিয়া ফেলিল। বভ্রুবাহণও তাহা দেখিয়া দুঃখে অজ্ঞান হইয়া গেলেন।

 এই বিষম বিপদের সময়, চিত্রাঙ্গদা কাঁপিতে কাঁপিতে সেখানে আসিয়া উলুপীকে দেখিয়াই বলিলেন, “উলুপি! তোমার দোষেই এই বিপদ উপস্থিত হইল।” বভ্রুবাহণও সেই সময়ে জ্ঞানলাভ করিয়া, উলুপীকে তিরস্কারপূর্বক বলিলেন, “পিতাকে মারিয়াছি, সুতরাং আমিও এখনি প্রাণত্যাগ করিব। তাহা হইলে হয়তো তুমি সন্তুষ্ট হইবে।”

 উলুপী যথাসাধ্য ইহাদিগকে সান্ত্বনা দিয়ে তখনি নাগলোক হইতে সঞ্জীবনী মণি আনাইলেন। সে মণির কি আশ্চর্য গুণ! উহা অর্জুনের বুকে স্থাপনমাত্রই তিনি চক্ষু মার্জনাপূর্বক উঠিয়া বসিলেন, যেন তাঁহার ঘুম ভাঙ্গিল।

 তারপর অবশ্য খুব সুখের অবস্থাই হইল। আর তখন এ কথাও জানা গেল যে উলুপী অতি মহৎ অভিপ্রায়েই এই ব্যাপার ঘটাইয়াছিলেন। শিখণ্ডীর সহায়তায় ভীষ্মকে বধ করায়, অর্জুনের যথেষ্ট অপরাধ হইয়াছিল। সেই অপরাধে বসুগণ এবং গঙ্গাদেবী তাঁহাকে শাপ দিতে প্রস্তুত হন। উলুপী সে সময়ে তথায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি এবং তাঁহার পিতা সেই দেবতাদিগকে অর্জুনের প্রতি প্রসন্ন হওয়ার জন্য বিস্তর মিনতি করায়, তাঁহারা বলেন, “বভ্রুবাহণ অর্জুনকে বধ করিলে, তবে তাঁহার শাপ কাটিবে।” এইজন্যই উলুপী বভ্রুবাহণকে অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে উৎসাহ দেন। তিনি জানিতেন যে, অর্জুনকে বাঁচাইবার ঔষধ তাঁহার ঘরে আছে! এ সকল কথা জানিতে পারিয়া সকলেই যে উলুপীর উপর অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, তাহাতে আর সন্দেহ কি?

 তখন বভ্রুবাহণ, চিত্রাঙ্গদা আর উলুপীকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণপূর্বক, অর্জুন পুনরায় তথা হইতে যাত্রা করিলেন।

 মগধে জরাসন্ধের নাতি মেঘসন্ধিও অন্যান্য অনেক মূর্খের ন্যায়, মনে করিয়াছিলেন যে, অর্জুন অপেক্ষা তিনি নিজে অধিক যোদ্ধা। অর্জুন, যুধিষ্ঠিরের কথা মনে করিয়া যতই তাঁহাকে বাঁচাইয়া বাণ মারিতে যান, ততই তাহার আরো সাহস বাড়িয়া যায়। শেষে অবোধের যে দশা সচরাচর হয়, তাঁহারও তাহাই হইল, তাঁহার আর অস্ত্র নাই। তখন অর্জুন তাহাকে বলিলেন, “তুমি ছেলেমানুষ হইয়া বেশ যুদ্ধ করিয়াছ, এখন ঘরে যাও! আমি তোমাকে বধ করিব না।” তাহাতে মেঘসন্ধি করজোড়ে কহিলেন, “মহাশয়! আমি পরাজিত হইয়াছি। এখন অনুমতি করুন, কি করিব।” অর্জুন বলিলেন, “চৈত্র মাসের পূর্ণিমার দিন মহারাজ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ দেখিতে যাইবে।” এই বলিয়া তিনি সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন।

 গান্ধার দেশে শকুনির পুত্রও প্রথমে ভারি তেজ দেখাইয়াছিলেন। অর্জুন কৃপাপূর্বক, তাঁহার মাথা না কাটিয়া, পাগড়িটি উড়াইয়া দিলে, তাহার চৈতন্য হইল।

 এইরূপে এক বৎসরকাল ঘোড়াটিকে দেশে দেশে ভ্রমণ করাইয়া তাহাকে হস্তিনায় ফিরাইয়া আনিলে, সেই ঘোড়ার মাংস দিয়া যজ্ঞ সম্পন্ন হইল। সেরূপ যজ্ঞ আর তাহার পরে কখনো হয় নাই। এমন কোনো আত্মীয়-স্বজন, এমন কোনো রাজারাজড়া এমন কোনো মুনি-ঋষি বা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন না, যিনি সেই যজ্ঞে না আসিয়াছিলেন।