পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
৩৩৯

তারপর ক্রমে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইলে, কৃতবর্মার লোকেরা, কৃষ্ণের সম্মুখেই, সাত্যকি এবং প্রদ্যুম্নকে বধ করিল। তাহাতে কৃষ্ণ নিকটস্থ শরবণ হইতে এক মুষ্টি শর তুলিয়া লইবামাত্র তাহা একটা মুদগর হইয়া গেল! সেই মুদগর দিয়া তিনি কৃতবর্মার পক্ষের লোকদিগকে বিনাশ করিলেন।

 মুনির শাপের কি বিষম তেজ! সে সময়ে কেহ একটিমাত্র শর তুলিয়া লইলেও তাহা বজ্রের মতন হইয়া যাইতে লাগিল। সেই শরের ঘায়ে কৃষ্ণের সাক্ষাতেই তাহার পুত্র, ভাই, নাতি প্রভৃতির মৃত্যু হইলে, তিনি ক্রোধভরে সেখানকার প্রায় সকলকে মারিয়া শেষ করিলেন।

 তারপর কৃষ্ণ, বভ্রু এবং দারুক, বলরামকে খুঁজিতে খুঁজিতে দেখিলেন যে, তিনি এক বৃক্ষের তলায় বসিয়া চিন্তা করিতেছেন। তখন কৃষ্ণ, অর্জুনের নিকট সংবাদ দিবার জন্য দারুককে হস্তিনায় পাঠাইয়া বভ্রুকে বলিলেন, “বভ্রু, তুমি শীঘ্র গিয়া স্ত্রীলোকদিগকে রক্ষা কর।”

 কিন্তু বভ্রু অধিক দূর না যাইতেই এক ব্যাধের মুদগর আসিয়া তাঁহার উপরে পড়ায় তাঁহার মৃত্যু হইল। তাহা দেখিয়া কৃষ্ণ বলরামকে সেইখানে তাঁহার অপেক্ষা করিতে বলিয়া, নিজেই স্ত্রীলোকদিগকে রক্ষার ব্যবস্থা করিতে গেলেন।

 নিজের পিতা বসুদেবের হাতে এই কার্যের ভার দিয়া কৃষ্ণ আবার বলরামের নিকট আসিয়া দেখেন যে তাহার মুখ দিয়া সহস্র ফণাযুক্ত ভয়ংকর এক সাপ নির্গত হইতেছে! উহার শরীর শেতবর্ণ এবং মুখসকল লাল! বাহির হইয়াই সেই সাপ সমুদ্রের দিকে ছুটিয়া চলিলে, সমুদ্র, বরুণ এবং প্রধান প্রধান নাগগণ তাহার পূজা করিতে করিতে, তাহাকে লইয়া গেলেন। বলরামের অসার নির্জীব দেহ সেইখানেই পড়িয়া রহিল।

 কৃষ্ণ বুঝিতে পারিলেন যে, বলরাম ঐ সর্পরূপেই নিজের দেহত্যাগ করিয়া গেলেন। ইহাতে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া, বন মধ্যে ঘুরিতে ঘুরিতে, তিনি এক স্থানে শয়ন করিয়াছেন, এমন সময় জরা নামক এক ব্যাধ, মৃগ মনে করিয়া তাঁহার প্রতি এক বাণ মারিল। সেই বাণ তাঁহার পদতলে বিঁধিয়া গেল। ব্যাধ জানে, হরিণই পড়িয়াছে কিন্তু তথায় উপস্থিত হইয়া বুঝিতে পারিল, সে কি সর্বনাশ করিয়াছে! অমনি সে কৃষ্ণের পায়ে লুটাইয়া পড়িল। কিন্তু কৃষ্ণ তাহার উপর কিছুমাত্র রাগ না করিয়া তাহাকে সান্ত্বনাপূর্বক স্বর্গে চলিয়া গেলেন।

 এদিকে দারুকের নিকট সংবাদ পাইয়া, অর্জুন দ্বারকায় আসিয়া দেখিলেন যে, দ্বারকাপুরী শ্মশান হইয়া গিয়াছে। বসুদেব তখনো জীবিত ছিলেন, কিন্তু পরদিন তিনিও মারা গেলেন।

 তখন আর দুঃখ করিবার সময় ছিল না। বসুদেবের এবং প্রভাস তীর্থে নিহত যাদবগণের সৎকারের অন্য লোক উপস্থিত না থাকায়, অর্জুনকেই সর্বাগ্রে সে সকল কাজের চেষ্টা দেখিতে হইল। তারপর কৃষ্ণের পৌত্র বজ্র এবং দ্বারকার স্ত্রীলোকদিগকে লইয়া তিনি ইন্দ্রপ্রস্থ যাত্রা করিলেন। সেই সময়ে একটি অতি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। অর্জুন সকলকে লইয়া দ্বারকানগরের যে স্থানই ছাড়িয়া যান, অমনি সমুদ্র আসিয়া তাহা গ্রাস করিতে লাগিল।

 তারপর কি নিদারুণ ব্যাপার হইল শুন। অর্জুন দ্বারকার স্ত্রীলোকদিগকে লইয়া ইন্দ্রপ্রস্থ যাত্রা করিলে পথমধ্যে একদল দস্যু আসিয়া তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিল। অর্জুন দস্যুনাশার্থ গাণ্ডীব তুলিতে গিয়া দেখেন, দেহে বল কিছুমাত্রও নাই, গুণটুকু পরানোই প্রায় অসাধ্য হইয়াছে। বহু কষ্টে যদি গুণ পরানো হইল, উৎকৃষ্ট অস্ত্রগুলির কথা কিছুতেই মনে পড়িল