পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৩৪৯

 সেই বাড়ির কর্তা আমাদের অবস্থা দেখিয়া বড় দুঃখিত হইলেন, আমাদের সম্বন্ধে যা যা কথা সমস্ত জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। আমরা কোনো কথারই ঠিক উত্তর দিই নাই। স্থানে স্থানে দু-একটি কথা গড়িয়া কহিতে হইল। তিনি আমাদের কথায় বুঝিয়া লইলেন যে আমরা দুজন পথ হারাইয়া ঘুরিতেছি, বলিলেন, 'কাল আমি একজন লোক দিয়া তোমাদের দুজনকে বাড়ি পাঠাইয়া দিব।'

 খাইবার সময় ভদ্রলোকটি আমাদের সম্মুখে বসিয়া থাকিলেন, আমাদের আহার শেষ হওয়া পর্যন্ত উঠিলো না। একটি কুঠুরিতে আমাদের দুজনের ঘুমাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হইল। সেখানে আর কেহ ঘুমাইতে আসিল না। আমি কিছু সুবিধা ভোগ করিলাম, ভাবিলাম কর্তা যাহা বলিলেন তাহা কাজে করিলে আর বড়লোক হওয়া হইবে না, সুতরাং কেহ জাগিবার পূর্বেই কর্তাকে ধন্যবাদ না দিয়া চলিয়া যাওয়া ঠিক হইল। সতীশকে ডাকিলাম, 'সতীশ! সতীশ!' সতীশ কথা কয় না। সতীশের চক্ষে জল পড়িতেছে। কর্তার কথায় সতীশের মন ফিরিয়া গেল নাকি? বাস্তবিকও তাই, অনেক পীড়াপীড়ি করার পর বলিল, আমি তোমার সঙ্গে যাইব না। আপনারা কি মনে করিতেছেন? সতীশের কথা শুনিয়া আমার মনের ভাব কিপ্রকার হইল? বড়লোক হওয়ার ইচ্ছাটা আমার এত বেশি হইয়াছিল যে, বাড়ি ছাড়িয়া অবধি আমার বোধ হইতেছিল—যেন বড়লোকের কাছাকাছি একটা কিছু হইয়াছি! সতীশকে আমি কাপুরুষ মনে করিতে লাগিলাম, সতীশের মা বাপ আছে আমারও মা বাপ আছে। প্রভেদ এই যে আমি স্বার্থপর, সতীশ তাহা নহে। সতীশের মনে যে-সকল চিস্তা উঠিতেছিল, আমার অন্তঃকরণে তাহার স্থান পাইল না। আমি সতীশের অবস্থা বুঝিতে পারিলাম না। মা বাপের মনে কষ্ট দেওয়া আমার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু নিজের কথা লইয়া এত ব্যস্ত ছিলাম যে তাহাদের কথা ভাবিবার অবসরই পাই নাই। নানা চিন্তার মধ্যে ঘুম আসিল।

 ঘুমাইতে ঘুমাইতে স্বপ্ন দেখিলাম যে, আমি বাড়িতে কি একটা কথা লইয়া মার সঙ্গে রাগারাগি করিয়াছি। মা কত সাধিতেছে আমার ভূক্ষেপ নাই, রাগ যেন ক্রমেই বাড়িতেছে। মার চক্ষে জল পড়িতেছে দেখিয়া যেন আমার প্রতিহিংসার ভাবটা চরিতার্থ হইতে লাগিল। আমি দাঁত খিঁচাইয়া মাকে বিদ্রুপ করিতে লাগিলাম। মা আমার হাত ধরিতে আসিলেন, আমি পাশের একটা গাছে উঠিতে চেষ্টা করিলাম। হঠাৎ পা পিছলাইয়া পড়িয়া যাইতেছিলাম, এমন সময় আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল। স্বপ্নের কথা ভাবিয়া চক্ষে দুফোঁটা জল আসিল, কিন্তু আবার সেই বড়লোক হওয়ার কথা। সতীশের মন ফিরিয়া গিয়াছে। সতীশ জাগিয়া আর যাইতে চাহিবে না, হয়ত আমারও যাওয়া হইবে না। রাত হয়ত আর বেশি নাই, এইবেলা সতীশকে না বলিয়া যাওয়াই ভাল। আমি আস্তে আস্তে উঠিলাম। আমার কাপড় আর টাকাগুলি লইয়া বাহির হইলাম। রাত্রি তখনো অনেক ছিল, কিন্তু আমার বোধ হইতে লাগিল যেন এই ভোর হইয়া আসিতেছে। একটা বড় রাস্তা ধরিয়া চলিলাম। অনেকক্ষণ হাঁটিলাম, কিন্তু রাত ফুরায় না। রাস্তাটা একটা বড় নদীর ধারে যাইয়া শেষ হইয়াছে, আমিও সেইস্থানে যাইয়া থামিলাম। তারপর যাই কোথা? রাস্তাটা নিশ্চয় ওপারে যাইয়া আবার চলিয়াছে। কিন্তু ওপারে যাই কেমন করিয়া? এতক্ষণ রাত ফুরাইল না। হয়ত আরো অনেক দেরি। ঘাটে একখানি নৌকা বাঁধা ছিল— নৌকার ছই নাই। একজন লোককে অনায়াসে ওরূপ