পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৫০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

নৌকা অনেকবার চালাইতে দেখিয়াছি, আমার বোধ হইতে লাগিল আমিও পারি। নৌকায় উঠিতে বিলম্ব হইল না। যে লগিটিতে নৌকা বাধা ছিল তাহা তুলিয়া লইলাম। ডাঙ্গায় ভর করিয়া ঠেলিয়া নৌকা জলে ভাসাইয়া দিলাম। জলের গায় এত জোর আগে ভাবি নাই। শোঁ শোঁ করিয়া নৌকার গায় জল বাঁধিতে লাগিল, নৌকাখানা ঘুরিয়া গেল। হঠাৎ ঘুরিবার সময় তাড়াতাড়ি লগিটি ছাড়িয়া দিলাম। নৌকা ঘুরিয়া ঘুরিয়া ডাঙ্গা হইতে অনেক দূরে যাইয়া পড়িল - স্রোতে ভয়ানক বেগের সহিত ভাসিয়া যাইতে লাগিল, আমি কিছুকাল হতবুদ্ধি হইয়া থাকিলাম।

 বিপদের পরিণামটা প্রথম তত বুঝি নাই, শেষে কিছু কিছু করিয়া হুঁস হইতে লাগিল। মাথা ঘুরিয়া গেল। দুহাতে চোখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়িলাম। ঢেউগুলি তড়াক তড়াক করিয়া নৌকাখানিকে দোলাইতে লাগিল, তখন মায়ের সেই মুখখানি মনে হইল। কেন বাড়ি ছাড়িয়া আসিলাম? সেই অন্ধকার রাত্রি, ভয়ানক নদী, আর বাড়ির ছোট কুঠুরীটি— সেই কোমল সুন্দর বিছানাটি মনে হইল। দুই চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। সেই আঁধারে পড়িয়া, মা মা বলিয়া কাঁদিতে লাগিলাম। কেন সতীশের সঙ্গে গেলাম না? তাহাকে কেন ছাড়িয়া আসিলাম?

 এইভাবে কতক্ষণ ছিলাম বলিতে পারি না। হঠাৎ নৌকাখানি একদিকে যাইয়া ঠেকিল। চমকিয়া দেখিলাম কতকগুলি বড় বড় নৌকা তাহারি একটাতে আমার নৌকা ঠেকিয়াছে। আমি সেই মুহূর্তের জন্য আশ্বস্ত হইলাম। কিন্তু তার পরক্ষণেই নৌকা হইতে কতকগুলি কালো অর্ধ-উলঙ্গ লোক বাহির হইয়া কেঁউ মেউ করিয়া কি বলিতে লাগিল, আমি বুঝিতে পারিলাম আমাকে গালি দিতেছে, তাহারা আমার কথা বুঝিল বলিয়া বোধ হইল না। আরো বেশি গালাগালি দিতে লাগিল। ক্রমে অন্যান্য নৌকার লোক আসিয়া গোলমালে যোগ দিল। আমার কথা শুনিয়া সকলেই ঐ লোকগুলিকে গালি দিতে লাগিল। একটি ভদ্রলোক সেখানে ছিলেন, তিনি দয়া করিয়া আমাকে তাঁহার নৌকায় লইয়া গেলেন, নিজ হাতে আমার পুঁটলিটি যত্ন সহকারে এককোণে রাখিয়া দিলেন। তারপর আমাকে বলিলেন, “আমি কা— যাইতেছি, তোমার আপত্তি না থাকিলে আমার সঙ্গে যাইতে পার, আমার বাড়িতে তোমার কোন ক্লেশ হইবে না। আমি তাঁহার সঙ্গে চলিলাম।

 কা— ছোট একটি শহরের মত। অনেক লোক। বড়লোকও অনেকগুলি আছেন। আমি যাঁহার সঙ্গে গিয়াছিলাম, তাহাকে এখানে কালিদাসবাবু বলিব, তিনিও একজন বড়লোক। এইসব দেখিয়া শুনিয়া আমার পুরাতন রোগ আবার দেখা দিল। আমি ভাবিতে লাগিলাম এখানে থাকিয়া বড়লোক হওয়া যায় কি? যায় বইকি। না হইলে ইহাৱা এত গাড়ি চড়ে কি করিয়া? বোধ হইল যেন কালিদাসবাবুর বাড়িতে থাকিয়া থাকিয়া হঠাৎ একদিন বড়লোক হইয়া যাইব। একদিন কালিদাসবাবু ডাকিলেন। কালিদাসবাবুর উপর প্রথম হইতেই আমার বড় শ্রদ্ধা হইয়াছিল। যখনই তিনি আমাকে ডাকিতেন তখনই একখানা সুন্দর কিছু উপহার পাইতাম। আমার বয়সের অনেকেই এখন ভাল কাজ করিতেছে, কিন্তু আমার যেন তখনো শিশু ভাবটা যায় নাই। কালিদাসবাবুও তাই বেশ বুঝিতেন, যাহা হউক আমি কালিদাসবাবুর নিকট যাইয়া দাঁড়াইলাম। তিনি আমার নাম ধরিয়া বলিলেন, 'গিরিশ, এখানে তোমার কেমন লাগে?'