পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৩৫১

 ‘দিব্যি।

 বটে? তা এখান থেকে তোমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না?

 ‘কোথায় যাব? এখানেই থাকব।'

 'তা বেশ’ বলিয়া কালিদাসবাবু কপাল হইতে চশমা নামাইয়া ছাপার কাগজ পড়িতে লাগিলেন। কাগজের প্রথম পাতে একটা ছবি। আমার সেই সাহেব! আমি একটু আশ্চর্য হইলাম। অনেকদিন পরে কোনো পরিচিত বন্ধুর সাক্ষাৎ পাইলে যেরূপ হয় আমারও সেইরূপ হইল। একটি ছোট কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হইল, আমি বলিয়া উঠিলাম, আরে!'কালিদাসবাবু কাগজ নামাইয়া আমার মুখের দিকে চাইলেন। তাহার অর্থ, ব্যাপারখানা কি?

 আমি বলিলাম, 'আজ্ঞে ঐ ছবিটে!'

 'ইনি একজন বড়লোক ছিলেন, তোমারও বড়লোক হতে ইচ্ছে হয়, না?'

 আমি ভাবিলাম এই বুঝি। হঠাৎ প্রশ্ন হওয়াতে থতমত খাইয়া বলিলাম, 'বড়লোক কি সবাই হয়?'

 'হয় বইকি। ইচ্ছে করলে তুমিও হতে পার।'

 'আমি পারি?'

 ‘অবিশ্যি। কাল থেকে তোমাকে ইস্কুলে পাঠিয়ে দেব ভেবেছি। লেখাপড়া না শিখলে বড়লোক হওয়া যায় না। তাই তোমাকে ডেকেছিলাম। কেমন?'

 আমার বাতাসের ঘর ভাঙিয়া গেল। যার চোটে বাড়ি ছাড়া সেই আপদ! আমি কোন কথা কহিলাম না।

 কালিদাসবাবু এতে সন্দেহ করেন নাই, সুতরাং কিছু বলিলেন না। এরূপ কথাবার্তা কালিদাসবাবুতে আর আমাতে অনেকদিন হইত। তিনি আমার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন। ‘সেই রাত্রিতে সেই নৌকায় কেমন করিয়া আসিলে!' 'বাড়ি কোথা?' 'মা বাপ নাই?' ইত্যাদি – আমি প্রায়ই চুপ করিয়া থাকিতাম। কালিদাসবাবুর ইচ্ছা ছিল, সুযোগ পাইলেই আমাকে বাড়ি পাঠাইয়া দিবেন। কিন্তু এ-সব সম্বন্ধে কোনো খবরই আমি তাঁহাকে দিতে চাহিতাম না। তখন তিনি সে-সব বিষয়ে ক্ষান্ত হইয়া সেখানেই আমাকে লেখাপড়া শিখাইবার মনস্থ করিলেন।

 ইস্কুলে যাইয়া অবধি আমার আর মনে শান্তি ছিল না। কয়েকদিন কোনো মতে কাটাইলাম, কিন্তু শেষটা অসহ্য হইয়া উঠিল। কালিদাসবাবুর বাড়িতে থাকা হইবে না। কিন্তু হঠাৎ যাই কোথায়? গেলেও আর এবার হাঁটিয়া যাওয়া হইবে না। কা- হইতে দুখানা স্টিমার ধু- তে যাতায়াত করিত। সপ্তাহের দুদিন স্টিমার চলে। ধু- যাইতে তিনদিন লাগে। হিন্দুরা এই তিনদিনের চিঁড়ে পুটলি-বাঁধিয়া লইয়া জাহাজে উঠে। ভোরবেলা জাহাজ ছাড়ে।

 একদিন নদীর ধারে বেড়াইতে যাইয়া দেখি একখানা স্টিমার এইমাত্র ঘাটে আসিয়া থামিল। পরের দিন ভোরে চলিয়া যাইবে। হঠাৎ স্টিমারে উঠিয়া ধু- চলিয়া যাইতে আমার বড় ইচ্ছা হইতে লাগিল, বাড়ি আসিয়া কেহ না দেখে এমনভাবে আমার কাপড়- চোপড় সব একত্র জড় করিলাম। কালিদাসবাবুর বাড়ি আসিবার কালে সঙ্গে করিয়া যে টাকা আনিয়াছিলাম তাহার একটিও ব্যয় হয় নাই। কালিদাসবাবুও মাঝে মাঝে আমার