পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৫২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

ইচ্ছামত খরচ করিবার জন্য দু-একটি দিতেন। আমি সমস্তই সঞ্চয় করিতাম। শুনিয়াছিলাম, বড়লোকেরা সহজে টাকা খরচ করিতে চাহে না।

 যাত্রার উপযোগী সকল জিনিস প্রস্তুত রাখিয়া ঘুমাইলাম। মনে একটা চিন্তা থাকিলে সহজে ঘুম হয় না, ঘুম হইলেও শীঘ্রই ভাঙিয়া যায়। আমারও তাই হইল, বড় কামরার ঘড়িতে চারটা বাজিল, আমি অমনি উঠিলাম। সঙ্গে পুঁটলিটি। পুটুলিতে কয়েকখানা কাপড়, একজোড়া চটী-জুতো,নগদ কিছুটাকা, কালিদাসবাবু মাঝে মাঝে যে উপহার দিতে সেগুলি কয়েকখানা ছবি, একটা বড় ছুরি আর আমার স্কুলে পুস্তকগুলি। পুস্তকগুলি কেন সঙ্গে লইলাম ঠিক বলিতে পারি না, তবে কালিদাসবাবু বলিয়াছিলেন, লেখাপড়া না শিখলে বড়লোক হওয়া যায় না। তাহাতেই মনে কেমন একটা ভয় রহিয়া গিয়াছিল। এইরূপ সাজ- সজা করিয়া, ছাতাটি হাতে করিয়া, বিছানার চাদর-খানা পুঁটুলির উপর জড়াইয়া আস্তে আস্তে বাহির হইলাম, স্টিমার ঘাটে আসিতে অধিকক্ষণ লাগিল না। সেখানেই মুদীর দোকান আছে, সেই দোকান হইতে চিঁড়ে কিনিয়া বিছানার চাদরের এক কোণে বাধিয়া লইয়া, জাহাজের একজন লোক আমাকে একটা জায়গা দেখাইয়া দিল, আমি সেইখানে যাইয়া বসিলাম। জাহাজে বিশেষ কিছু ঘটনা হইল না। তবে সঙ্গে যে টাকা আনিয়াছিলাম তাহা প্রায় শেষ হইয়া আসিল। নিয়মিত সময় জাহাজ ধু- পৌছিল।

 রামলোচনবাবু আমাদের ওদিককার লোক, তিনি ধু- তে থাকেন, সেখানকার একজন নামজাদা উকিল। আমি ভাবিলাম দেশের একজন লোক, তাঁর কাছে গেলে তিনি অবশ্যই কিছু খাতির করিবেন। জাহাজ হইতে তীরে উঠিয়াই তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। একটি ভদ্রলোক তাঁহার বাড়ি দেখাইয়া দিলেন। আমি আস্তে আস্তে বাড়ির একজন চাকরের মত লোককে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, 'রামলোচনবাবুর এই বাড়ি?' সে লোকটা আমার কথার উত্তর দেওয়া দূরে থাকুক আমার দিকে একবার ফিরিয়াও চাহিল না। মুখ বিকৃত করিয়া একটা বড় ঘরে চলিয়া গেল, অগত্যা আমি অন্য লোকের আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। সে যাহা বলিল তাহাতে জানিলাম, আমি যাহাকে রামলোচনবাবুর চাকর মনে করিয়াছিলাম, তিনিই রামলোচনবাবু। তাই অত রাগ! আমি ভয়ে ভয়ে রামলোচনবাবুর ঘরে দরজায় দাঁড়াইলাম। তিনি একটা তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া রহিয়াছে। অত কালো আমি আর দেখি নাই। মোটা বেশি নন, কিন্তু প্রায় বুকের উপর কাপড় পরেন। গোপগুলি সোজা সোজা, চুল অধিকাংশ পাকিয়া গিয়াছে। কানে একটা কলম, হাঁটুর উপর পর্যন্ত কাপড় টানিয়া বসিয়াছে। উরুদেশের উপর একটা লম্বা খাতা রাখিয়া তাহাই দেখিতেছে, আর মাঝে মাঝে কাহার উদ্দেশে মুখ বাঁকাইতেছে। তাকিয়ার একটা অংশ কলম মুছিবার স্থান বলিয়া বোধ হইল। কিছুকাল পরে দেখিলাম যে তাহা নহে। পাশে একটি মাটির দোয়াত, তাহা হইতে ঘটিয়া এক কলম কালি লইয়া খাতায় যেন কি লিখিলেন। তারপর কলমটি মাথার চুলে ঘসিয়া কানে বসাইয়া হাতের মুই তাকিয়ার উপর রাখিয়া, একখানা পা আমার দিকে বাড়াইয়া ভাউ’ শব্দে উদগার করিলেন। শেষটা আমার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিলেন। প্রথম প্রশ্নে হিন্দী ভাষায় হইল, তারপর পর বাঙলা।

 ‘কি চাই?'

 'আজ্ঞে আমি অনেক দূর থেকে এসেছি-'