কষ্ট পাইলাম, কিন্তু বড়লোক হইবার ত লক্ষণ দেখিতেছি না। কেবল বাড়ি হইতে চলিয়া আসিলেই কি বড়লোক হওয়া যায়? আরো কিছু চাই, আমার তাহা নাই। এইরূপ যতই ভাবিতে লাগিলাম ততই বাড়ি ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা হইতে লাগিল। শেষটা ঠিক করলাম বাড়ি যাইতে হইবে। আমার হাতে যে কিছু টাকা আছে তাহাতে পথ খরচা চলিবে না। সুতরাং এবার স্টিমারে যাওয়া হইবে না। বৈ-তীর্থ এখান হইতে বড় বেশি দূরে নয়, সেখানে গেলে সঙ্গী পাওয়া যাইতে পারে। এইরূপ চিন্তার পর মনে করিলাম, বাবুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া বৈ—যাইব, সেখানে সঙ্গী পাইলে তাহাদের সহিত বাড়ি যাইব।
কর্তার নিকট হইতে বিদায় লইয়া বৈ— আসিতে বড় বেশি দেরি হইল না। জায়গাটা দেখিতে বড় সুন্দর, একটি ছোট পাহাড়, তার উপরে তীর্থ স্থান। পাথরের গায়ে সিঁড়ি কাটা আছে। সেই সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে হয়। অনেকগুলি সিঁড়ি, উঠিতে অনেকক্ষণ লাগে। আমি উঠিতে উঠিতে তিনবার বিশ্রাম করিলাম। প্রথমেই যাহাকে দেখিলাম তাহার নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, 'যাত্রীরা কোথায় থাকে?' সে বলিল, 'যাত্রীদের থাকিবার ভাল জায়গা নাই। প্রায় সকলেই পাদের বাড়িতে থাকে। উপরে যে দেব মন্দির, সেই মন্দিরের পুরোহিতদের নাম পাণ্ডা। পাণ্ডা খুঁজিতে অধিকক্ষণ ঘুরিতে হইল না। প্রথম যে পাণ্ডা আমাকে দেখিল সেই হাত ধরিয়া আমাকে তাহার বাড়ি লইয়া গেল।'
পাণ্ডার বাড়ি দুদিন থাকিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে বিষয়টা তত সুবিধাজনক নহে। আমি যে সময় গিয়াছি সে সময় যাত্রীরা প্রায়ই আসে না। সঙ্গী পাইতে হইলে আরো তিনমাস অপেক্ষা করিতে হইবে। তিন মাসের ত কথাই নাই, পাণ্ডা মহাশয় যেরূপ করিলেন তাহাতে তৃতীয় দিনেই আমাকে পৃষ্ঠ ভঙ্গ দিতে হইল। তৃতীয় দিন সকালে পাণ্ডা আসিয়া বলিলেন, ‘দেখিবি? চল। আমি চলিলাম। অনেক জিনিস দেখা হইল। শেষে এক জায়গায় গেলাম, সেটি একটি বড় মন্দির। মধ্যে গহ্বর, গহূরে নীচে ছোট এক ঝরনার মত। পাণ্ডা বলিল, ‘এখানে পূজা করিতে হইবে। কত লাগিবে তাহারও হিসাব দেওয়া হইল। আমি দেখিলাম, তা হলে আমার বাড়ি যাওয়া হয় না। আমি বলিলাম, আমি ছেলেমানুষ, পূজা কি করিব?’ পাণ্ডা চটিয়া গেল, সেদিন হইতে আর আমাকে তাহার বাড়িতে জায়গা দিল না। অগত্যা আমায় সেখান হইতে প্রস্থান করিতে হইল। কিছুদূর গেলেই কতকগুলি ছোট ছোট ছেলে আসিয়া পয়সা পয়সা করিয়া আমাকে ঘিরিয়া ধরিল। আমি কোনো মতেই পয়সা দিতে চাহিলাম না। তাহারা ক্ষেপিল। কেহ গাল দেয়, কেহ কাপড় ধরিয়া টানে, কেহ দুর হইতে ছোট ছোট ঢিল ছুঁডিয়া ফেলে। আমার মাথা গরম হইয়া গেল। কাছে একটা ছোট কাঠ পড়িয়াছিল, রাগের চোটে তাহাই হাতে করিয়া লইয়া ছেলেগুলাকে তাড়া করিলাম। মুহূর্তের মধ্যে সকলে অদৃশ্য হইল। আমার যেন ভুত ছড়িল। সেখান হইতে উধর্বশাসে দৌড়িয়া পাহাড়ের প্রায় অর্ধেক পথ আসিয়া পড়িলাম। তখন মনে হইল, জুতা জোড়াটি ফেলিয়া আসিয়াছি। কিন্তু ইহার পূর্বের পচিশ মিনিটের মধ্যে পাহাড় সম্বন্ধে যেটুকু জ্ঞানলাভ করিয়াছিলাম, তাহাতে মনে ভয়ানক আতঙ্ক উপস্থিত হইতে লাগিল। আমি জুতার আশা পরিত্যাগ করিলাম। চলিবার সময় সর্বদাই চটি জোড়াটি পুটলিতে বাঁধিয়া লইয়া যাইতাম, এক্ষণে তাহাই খুজিয়া লইলাম।
পাহাড়ের নীচে নামিতে নামিতে অনেক বেলা হইল। একটু একটু করিয়া ক্ষুধা বাড়িতে