পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৫৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 ‘তোমার উপর আমি রাগ করি নাই। তোমার কথায় আমার কিছুমাত্র অনিষ্ট হয় নাই। আমি ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিব, যেন তিনি তোমার ভাল করেন।' তাহাকে বুঝানো কিছুকষ্টকর বোধ হইল। কিন্তু শেষটা সে যেন সুখী হইল এবং বলিল, 'তবে যাই, মার কাছে বলিগে।'

 বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিলে সেই ছেলে দুটির নিকট বিদায় লইয়া বাহির হইলাম। সেদিন রাত্রিতে এক বাজারে মুদির দোকানে ছিলাম। তারপর দুই দিন ঐ ভাবে গেল। সারাদিন পথ চলিতাম; কেবল দু-বেলা খাবার জন্য কোনো মুদীর দোকানে, উঠিতাম। রাত্রিতে কোনো মুদীকে পয়সা দিয়া তাহার ঘরে থাকিবার জায়গা পাইতাম। তৃতীয় দিন রাত্রিতে থাকিবার জন্য আর মুদীর ঘর পাইলাম না। কাজেই একজন গৃহস্থের বাড়ি যাইতে হইল। গৃহস্থ জায়গা দিতে কোনো আপত্তি করিলেন না। কিন্তু খাওয়া শেষ হইলে 'কড়া’ 'বগুণো’ সব দেখাইয়া বলিলেন, 'কাল’ চলে যাবার আগে এইগুলো মেজে দিয়ে যেতে হবে। তুমি বাঙালী, তোমার এটো কে নেবে? আমি মহা বিপদে পড়িলাম। বলিলাম, ‘ওগুলো আমি ছুঁই নাই। তবে আমি যা যা ছুঁয়েছি সেগুলো দাও, এখনি মেজে দিচ্ছি।' সুতরাং একখানা থালা আর একটি বগুণো (বগুণোতে ডাল ছিল) আমার ঘাড়ে চাপিল। তিনি বাড়ির কাছে একটা পুকুর দেখাইয়া দিলেন;আমি তথায় যাইয়া সমস্ত পরিষ্কার করিয়া আসিলাম। প্রায় আধঘণ্টা সময় লাগিল।

 পরিশ্রমের পর সুনিদ্রা হইল। পরদিন গৃহস্থ ডাকিয়া ঘুম ভাঙাইলেন, উঠিয়া দেখি সূর্য উঠিয়াছে। তাড়াতাড়ি পুঁটলি হাতে করিয়া বাহির হইলাম। গৃহস্থের নিকট বিদায় লইবার সময় ফা- যাইবার পথ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, একটা বড় মাঠ, তারপর একটা পাহাড়, তারপর ফা— একই পথ, ভুল হবার জো নাই।'

 কিছুদূর হাঁটিয়াই একটা মাঠে আসিলাম। সেখানে পথিকদিগের জন্য একটি ঘর আছে। তথায় একজনার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তার সঙ্গে একটা ঘোড়া। সে আমাকে দেখিয়াই বলিল, ‘বেশ, চল। একজন সঙ্গীর জন্য বসিয়াছিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, সঙ্গীর প্রয়োজন কি? সে বলিল, তুমি আর কখনো এখানে চল নাই? একা গেলে খেয়ে ফেলবে। আমার ভয় হইল।

 মাঠের এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যায় না। অতি কম চওড়া পথ;দশ বার হাত অন্তর ছোট ছোট খসখসের ঝোপ। জীব জন্তুর মধ্যে এক জাতীয় পাখি। পাখিটি একটি চড়াই অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বড়, গায়ের রং সবুজ; ঠোট সরু এবং লম্বা, স্বভাব অত্যন্ত চঞ্চল। ক্রমাগত একই রূপ শব্দ করিতেছে-“টিরিরিণ টিরিরিণ টিরিরিণ।” লেজে একটা নতুনত্ব আছে। লেজের মধ্যদেশ হইতে প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা একটি সূচীর মত বাহির হইয়াছে। আমার সঙ্গী বলিল, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছুঁচ চুরি করেছিলেন। তাতেই ঐ শাস্তি।' অন্য কিছু থাকাতে ঐ পাখিকেই বারবার ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম।

 বেলা আন্দাজ চারিটার সময় ছোট একটি ঘর দেখিতে পাইলাম। সঙ্গী বলিল, “আজ এখানেই থাকিতে হইবে।” আমি প্রতিবাদ করিয়া বলিলাম, 'চারটের সময় বসে থাকতে হবে কেন?'

 সঙ্গী বলিল, 'মাঠে রাত হলে বাঘে খাবে। বাঘে খায় এরূপ ইচ্ছা আমার ছিল না।