পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৩৫৭

সুতরাং সে রাত্রির জন্য ঐ ঘরেই থাকিলাম। রাত্রিতে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া অনেকপ্রকার শব্দ শুনিতে পাইলাম। সেসব নাকি হাতির শব্দ। সৌভাগ্যক্রমে হাতিগণ আমাদের কোন খবর লইতে আসিলেন না। কিন্তু পরদিন উঠিয়া দেখি ঘোড়াটি নাই! ঘোড়ার স্বামী অনেক আক্ষেপ করিল।

 মাঠ পার হইতে প্রায় চারটা বাজিল। মাঠ যে জায়গায় শেষ হইয়াছে সেখানেও দেখিলাম একটি ছোট ঘর। সেখানে আসিলে সঙ্গী বিদায় লইয়া অন্য পথে গেল। আমি আমার নির্দিষ্ট পথে আস্তে আস্তে চলিলাম। কিছুদূর যাইয়া একটি মাহুতকে পাইলাম, সে হাতি লইয়া ফা—চলিয়াছে আমি চারি আনা পয়সা দিব বলাতে সে আমাকে তাহার হাতির পিঠে একটু স্থান দিল। মহাসুখে ফা—আসিলাম। কালিদাসবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে সাহস পাইলাম না। রাত্রিতে একটি মুদীর দোকানে থাকিয়া পরদিন ভোরে রওয়ানা হইলাম।

 পথে যেসকল ছোটখাট ঘটনা হইয়াছিল, তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই। তবে একদিনের কথা আবশ্যক। দুই প্রহরের পর আর মানুষের সাড়াশব্দ পাইলাম না। বেলা যতই কমিয়া আসিতে লাগিল, ততই ক্রমাগত নির্জন স্থানে যাইয়া পড়িতে লাগিলাম, তারপর কেবল একটা মাঠ দুই ধারে উলুবন এবং অন্যান্য দুই একটি ছোট ছেট গাছ। এরূপ জায়গায় সন্ধ্যা হইল। কি করি কোথায় যাই! প্রাণপণে দৌড়তে লাগিলাম। পথ এত সংকীর্ণ যে দুই পাশের গাছে গা লাগে। থাকিয়া থাকিয়া আমার বুক গুড় গুড় করিয়া উঠিতে লাগিলাম। এমন সময় হঠাৎ যেন পিঠে একটা কি লাগিল। চমকিয়া ফিরিয়া দেখিলাম একজন পাহাড়ী লোক। সে আমাকে কি একরকম ভাষায় বলিল—'তুই কোথায় যাস? তোর প্রাণের ভয় নাই? এই বলিয়া সে আমাকে তাহার পিছু পিছু যাইতে সংকেত করিল। আমি সহজেই তাহার আজ্ঞা পালন করিতে লাগিলাম। সে দুই হাতে উলুকন সরাইয়া শুয়োরের মত দৌড়াইতে লাগিল, আর মাঝে মাঝে আমাকে ডাকিয়া বলিতে লাগিল ‘আরে আয়, মরে যাবি।' আমি হতবুদ্ধি হইয়া তাহার অনুসরণ করিতে লাগিলাম।

 কতক্ষণ এইরূপে চলিলাম বলিতে পারি না। অবশেষে একটা বড় নদীর ধারে আসিলাম, সেখানে দেখিলাম আরো কয়েকজন লোক বসিয়া আছে। পাহাড়ী বলিল, যতক্ষণ নৌকা আসিয়া ও পারে না যায়, ততক্ষণ এখানে বসিয়া থাসিতে হইবে। আমি তাহাদের সঙ্গে মাটিতে বসিলাম। অন্যান্য সকলে পটুলি হইতে খাবার খুলিয়া খাইতে লাগিল। পাহাড়ীর সঙ্গে কতকগুলি কমলালেবু ছিল। সে আমাকে তাহার খাবার খাইতে দিল। আমি তাহাই খাইয়া, নাক মুখ কাপড়ে ঢাকিয়া সেইখানেই শুইয়া পড়িলাম। অন্যান্য লোকেরা আমাকে বলিতে লাগিল ‘ঘুমিও না, খেয়ে ফেলবে।' তেমন অবস্থায় ঐরূপ উপদেশ বাক্যের অত্যন্ত আবশ্যক ছিল, কারণ সমস্ত দিনের পরিশ্রমে আমার গা অবশ হইয়া আসিতেছিল। এবং একটুকু পরেই অতি নিকটে ‘ঘ্যাওর ঘ্যাওর’ করিয়া বাঘ ডাকিতে লাগিল। সমস্ত রাত্রি নিকটে হিংস্র জন্তুর শব্দ হইতে লাগিল। সে রাত্রির কথা আমার জীবনে আর কখনো ভুলি নাই। নৌকাওয়ালা পারে বসিয়া সুখভোগ করিতেছে সেখানে নৌকা বোঝই না হইলে ফিরিয়া আসিবে না। সমস্ত রাত্রি আমাদের প্রাণ হাতে করিয়া সেই ভয়ানক স্থানে বসিয়া থাকিতে হইল। পরদিন নৌকা আসিলে আমরা ওপারে গেলাম।

 ইহার তিনদিন পরে বাড়ির কাছে বাজারে আসিলাম, সেখানে দই চিঁড়ে সন্দেশ ইত্যাদি