দেখা যেত। সেদিকে কাউকে যেতে দেখলেই তিনি ‘কে-রে এ-এ’ বলে এমনি বিষম হাঁক দিতেন যে কি বলব! তখন আর হাত পা সামলে ছুটে দেবারও উপায় থাকত না। দু মাইল দূরে থেকে লোকে বলত, ‘ঐ রে! ঠাকুরদা তাঁর কুল আগলাচ্ছেন।’
খালি একবার ছেলেরা ঠাকুরদার কাছ থেকে একপোয়া সন্দেশ আদায় করেছিল। ঠাকুরদা চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বসে একমনে পুঁথি লিখছিলেন, তিনি দেখতে পান নি যে, এর মধ্যে ও পাড়ার বোসেদের বানরটা কেমন করে ছুটে এসে সেখানে উপস্থিত হয়েছে, আর তার পঁয়ত্রিশ বছরে পুরনো বাঁধানো হুঁকোটি নিয়ে গাছে উঠছে। তারপর তামাক খেতে গিতে দেখেন, কি সর্বনাশ! বানরটাকে তিনি কত ঢিল ছুঁড়ে মারলেন, কত লম্বা লম্বা সংস্কৃত বকুনি বকলেন, কিছুতেই তার কাছ থেকে হুঁকোটি আদায় করতে পারলেন না। লাভের মধ্যে সে বেটা তাঁকে গোটা দশেক ভেংচি মেরে হুঁকো সুদ্ধ পাশের বাড়ির আমবাগানে চলে গেল।
সেদিন ছেলেরা না থাকলে ঠাকুরদার আবার তাঁর হুঁকোর মুখ দেখবার কোনো আশাই ছিল না। তিনি তাদের সন্দেশ কবুল করে অনেক কষ্টে তাদের দিয়ে বানরের হাত থেকে হুঁকোটি আদায় করালেন। তার পরদিনই নিজে গিয়ে বেচু ময়রার দোকান থেকে তাদের জন্যে এক পোয়া সন্দেশ কিনে আনলেন। সে সন্দেশ খেয়ে নাকি তারা মুখ সিঁটকিয়েছিল। ঠাকুরদা তার কারণ জিজ্ঞাসা করতে তারা বলল, ‘সন্দেশটা বড্ড মিষ্টি।’ ঠাকুরদা তখন খুব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘তাই ত আমি জানতুম না তোমরা তেতো সন্দেশ খাও। আমি মিষ্টি সন্দেশ কিনে এনেছি।’
পয়সা খরচ নিয়ে কিন্তু ঠাকুরদার একটু বদনাম ছিল। ঐ যে হুঁকোর খাতিরে ছেলেদের একপোয়া সন্দেশ কিনে খাইয়েছিলেন, তাছাড়া আর তাঁর জীবনে তিনি কখনো কাউকে কিছু কিনে খাওয়ান নি। লোকে বলত তাঁর ঘরের ভিতরে তিন-জালা টাকা পোঁতা আছে। কিন্তু নিজে তিনি এমনভাবে চলতেন যেন অনেক কষ্টে তাঁর দুটি খাবার জোটে, সেও বুঝি-বা একবেলা বই দুবেলা নয়। একদিন দিদিমা ডাল রাঁধতে গিয়ে তাতে একটু বেশি ঘি দিয়ে ফেলেছিলেন, সেই অপরাধে নাকি ঠাকুরদা দুমাস তাঁর সঙ্গে কথা কন নি।
ছেলেরা তাঁর সেই সন্দেশ খেয়ে অবধি তাঁর উপর একটু চটেছিল। না চটবেই বা কেন? সেই হতভাগা বানরটার কাছ থেকে হুঁকো আদায় করতে গিয়ে কি তারা কম নাকাল হয়েছিল? কুড়ি জন মিলে তিনটি ঘণ্টা ধরে তারা সেদিন কত গাছই বেয়েছে, কত ছুটোছুটিই করেছে, কত কাদাই লাগিয়েছে, কত বিছুটির ছ্যাঁকাই খেয়েছে। তার পুরস্কার হল কিনা অমনিতর একপোয়া সন্দেশ।
তখন ছিল পুজোর সময়। কুমোরদের বাড়িতে অনেক ঠাকুর গড়া হচ্ছিল, তার তামাশা দেখবার জন্য সকালে বিকালে ছেলেদের প্রায় সকলেই সেখানে যেত। সেইখানে তাদের একটা মস্ত মিটিং হল, ঠাকুরদাকে জব্দ করতে হবে। তিনি যেমন সন্দেশ খাইয়েছেন, তাঁকে দিয়ে কিছু বেশি টাকা খরচ করাতে পারলে তবে তার দুঃখটা মেটে। কিন্তু এমন লোকের পয়সা ত সহজে খরচ করানো যেতে পারে না, তার কি উপায় হতে পারে।
কতজনে কত কথা বলতে লাগল। কেউ বলল, চল ঠাকুরদার কুলগাছ কেটে ফেলি। কেউ বলল, তাঁর হুঁকো লুকিয়ে রাখি। কিন্তু এসব কথা কারুর পছন্দ হল না। এমন