পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৩৮৩

বাঁশঝাড়, ঠানদিদির কাঁঠালগাছ, বিশেষ ভাবে ঠানদিদির কুলগাছ আর পেয়ারাগাছ।

 ঠানদিদির পুত্রসন্তান নেই, কেবল তিনটি মেয়ে। বড় মেয়ে দুটির বিবাহ হয়ে গিয়েছে। ছোটটির বয়স ন-দশ বৎসর। ঠানদিদির বয়স চল্লিশের উপর। বাড়িতে অন্য লোকজন নেই, কিন্তু তা হলেও, ঠাকুরদাদা বিদেশে গেলে ঠানদিদির চৌকিদার বা ঘরে শোবার জন্য বুড়ো স্ত্রীলোকের দরকার হয় না। ঠানদিদি অনায়াসে একাই থাকেন।

 একবার ঠাকুরদাদা বিদেশে গিয়েছেন। ঠানদিদি কেবল ছোট মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে আছেন, সেই সময়ে একদিন দুপুর রাত্রে মেয়েটি বলল, ‘মা! কে যেন আমার গায়ে হাত দিল!’ ঠানদিদি বললেন, ‘চুপ কর, কথা বলিস না।’ ঠানদিদি পূর্বেই টের পেয়েছেন, ঘরে চোর ঢুকেছে। তারপর চোর যেই বাক্স-পেঁটরার সন্ধানে ঘরের অন্য দিকে গিয়েছে অমনি ঠানদিদি আস্তে আস্তে উঠে, বাটনাবাটা শিলখানা এনে সিঁদের মুখে চাপা দিলেন।

 তোমরা শহরের ছেলেরা বোধ করি বুঝতে পারলে না, সিঁদ কি। পাড়াগাঁয়ে অনেক মেটে ঘর। ঐসব মেটে ঘরে সিঁদকাঠি খুঁড়ে চোর ঘরের ভিতর ঢুকে চুরি করে। এইবার আরো মুশকিল হল, সিঁদকাঠি কি? সিদকাঠি যে কি তা আমিও কখনো চোখে দেখি নি। সম্ভবত ওটা খন্তা বা সাবলের মত লোহার কোন অস্ত্র হবে।

 এই সিঁদকাঠি তৈরি সম্বন্ধে পাড়াগাঁয়ে একটা কথা আছে, ‘চোরে কামারে কখনো দেখা হয় না।’ সিঁদকাঠি যখন লোহার অস্ত্র, তখন অবশ্যই ওটা কামারে গড়ে। কিন্তু চোর কি কামারের বাড়ি গিয়ে বলে, ‘কর্মকার ভায়া, আমাকে একটা সিঁদকাঠি তৈরি করে দাও!’ নিশ্চয়ই না,তা হলে ত সেইখানেই সে চোর বলে ধরা দিল। কামার ভায়া চোরের নিতান্ত বন্ধু হলেও, সময় মত অন্য দু-দশজন বন্ধুর কাছে সে গল্পটা করবেই। দরকার হলে পুলিশের কাছেও বলতে পারে।

 তবে চোর কি করে সিঁদকাঠি গড়ায়? আমরা ছেলেবেলায় শুনতাম চোরের সিঁদকাঠির দরকার হলে, চোর একখানি লোহা আর একটি আধুলি রাত্রে কামারশালের এমন জায়গায় রেখে যায় যে কামার সকালে কামারশাল খুলবার সময়েই সেটা তার নজরে পড়ে। তখন কামার অন্য কাজ বন্ধ রেখে, সকলের অসাক্ষাতে সিঁদকাঠিটি তৈবি করে। কামারশাল বন্ধ করবার সময়, ঠিক সেই জায়গায় সেটি রেখে দেয়। রাত্রে চোর এসে সেটি নিয়ে যায়।


 এখন আসল কথা শোনো। ঠানদিদি সিঁদের মুখে শিলটি চাপা দিয়ে তার পাশে চুপ করে বসে আছেন। তারপর চোর একটি বাক্স এনে সিঁদের কাছে যেমন নামিয়েছে, অমনি বেটাকে জাপটে ধরেছেন। তখন চোর নাকি সুরে বলল, ‘মা ঠাকরুন, ছেড়ে দিন।’ ঠানদিদি বললেন, ‘বল বেটা তুই কে? নইলে এখনি পাড়ার লোক ডেকে তোকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করব।’ চোর দেখল নাম না বললে আর নিষ্কৃতি নেই, কাজেই বলল, ‘মা ঠাকরুণ, আমি শীতল!’ তা শুনে ঠানদিদি বললেন, ‘হতভাগা। মরতে আর জায়গা পাও নি? যাও! ঐ বাইরে কলসী আছে—পুকুরে গিয়ে জল আনো, তারপর কাদা করে সিঁদ বোজাও। ঐ গোয়ালে গোবর আছে গোবর দিয়ে ভিতর-বার ভাল করে নিকিয়ে দিয়ে যাও। আমি সকালে উঠে এ সব হাঙ্গামা কত্তে পারব না।’

 শীতল তখন কলসীটি নিয়ে আস্তে আস্তে পুকুর ঘাটে গেল। তখন ফাল্গুন মাস, পাড়া গাঁয়ে বেশ শীত। সেই শীতে পুকুর থেকে জল এনে, কাদা করে, সিঁদ বুজিয়ে, ভাল করে