পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৩৮৭

ধনী অনেক কথাবার্তার পর তাহাকে বলিল, ‘বাপু, তুমি ঘ্যাঁঘাসুরের দেশে চলেছ শুনছি, সে অনেক বিষয়ের খবর রাখে। আমার লোহার সিন্দুকের চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি ঘ্যাঁঘা তার কোন সন্ধান বলতে পারে কিনা, জিজ্ঞাসা করো ত।’ মানিক বলিল, ‘আচ্ছা মশাই, আমি জেনে আসব।’ আর-একদিন সে আর এক বড়লোকের বাড়িতে অতিথি হইয়াছে সেই বড়লোকের মেয়ের ভারি অসুখ। তাহার বেয়ারামটা যে কি কোনো ডাক্তার কবিরাজ তাহা ঠিক করিতে পারে না। মেয়ে দিন দিন খালি রোগা হইয়া যাইতেছে। সেই বড়লোক মানিককে খুব যত্ন করিয়া খাওয়াইয়া তারপর বলিলেন, ‘আমার মেয়ের অসুখ কিসে সারবে এই কথাটা যদি ঘ্যাঁঘার কাছে থেকে জেনে আসতে পার, তবে বড় উপকার হয়।’ মানিক বলিল, ‘অবিশ্যি মশাই, আমি নিশ্চয় জেনে আসব।’

 এইরূপে একমাস চলিয়া মানিক অজানা নদীর ধারে আসিয়া ওপারে ঘ্যাঁঘাসুরের সোনার বাড়ি দেখিতে পাইল। অজানা নদীর নৌকা নাই, খেয়া নাই; এক বুড়ো সকলকেই কাঁধে করিয়া পার করে। মানিকও তাহারি কাঁধে চড়িয়া নদী পার হইল। বুড়ো তাহাকে বলিল, ‘বাপু, আমার এই দুঃখ কবে দূর হবে, ঘ্যাঁঘার কাছে জিজ্ঞেস করো ত! আমার খাওয়া নাই, দাওয়া নাই, খালি কাঁধে করে দিনরাত্তির মানুষই পার করছি। ছেলেবেলা থেকে এই করছি আর এখন বুড়ো হয়ে গেছি।’ মানিক বলিল, ‘তোমার কিছু ভয় নেই, আমি নিশ্চয়ই তোমার কথা জিজ্ঞেস করব।’

 নদী পার হইয়া মানিক ঘ্যাঁঘার বাড়িতে গেল। ঘ্যাঁঘা তখন বাড়ি ছিল না; ঘেঁঘী ছিল। ঘেঁধী তাহাকে দেখিয়া বলিল, ‘পালা বাছা, শিগ্‌গির পালা। ঘ্যাঁঘা তোকে দেখতে পেলেই গিলবে।’ মানিক বলিল, ‘আমি যে ঘ্যাঁঘার লেজের একগাছি পালক চাই। সেটি না নিয়ে কেমন করে যাব? আর সেই যাদের চাবি হারিয়ে গেছে সেই চাবিটি কোথায় আছে? আর যাদের মেয়ের অসুখ, তারা ওষুধ জেনে যেতে বলেছে। আর যে বুড়ো পার করে দিলে, সে বাড়ি যাবে কেমন করে?’

 ঘেঁঘী বলিল, ‘প্রাণটি নিয়ে কোথায় পালাবে, না আবার তার পালক চাই, আর তাকে একশো খবর বলে দাও। তুই কে রে বাপু?’ মানিক বলিল, ‘আমি মানিক। পালক না নিয়ে গেলে রাজা মেয়ে বিয়ে দেবে না; একগাছি পালক আমার চাই।’

 হাজার হোক স্ত্রীলোেক। মানিককে দেখিয়া ঘেঁঘীর দয়া হইল। সে বলিল, ‘আচ্ছ বাপু, তাহলে তুই এই খাটের তলায় লুকিয়ে থাক্। তোর ভাগ্যে থাকলে হবে এখন।’ মানিক ঘ্যাঁঘার খাটের তলায় লুকাইয়া রহিল।

 সন্ধ্যার পর ঘ্যাঘাসুর বাড়ি আসিল। ঘেঁঘী তাড়াতাড়ি পা ধুইবার জলটল দিয়া সোনার থালায় খাবার হাজির করিল। ঘ্যাঁঘার মেজাজটা বড়ই খিটখিটে; সবটাতেই সে দোষ ধরে। বাড়ি আসিয়াই সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানিতে লাগিল, আর বলিতে লাগিল, ‘মানুষের গন্ধ কোথেকে এল? হুঁ হুঁ মানুষের গন্ধ। মানুষ দে, খাই।’

 ঘ্যাঁঘার কথা শুনিয়া খাটের তলায় মানিকলালের মুখ শুকাইয়া গেল, ঘেঁধীরও বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করিতে লাগিল। সে অনেক কৌশল করিয়া ঘ্যাঁঘাকে বুঝাইল যে, একটা মানুষ আসিয়াছিল, কিন্তু সেটা ঘ্যাঁঘার নাম শুনিয়াই পলাইয়াছে। ইহাতে ঘ্যাঁঘা কিছু শান্ত হইয়া খাবার খাইতে বসিল।