পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৩৯৯

মস্তবড় থলে ঝুলছে, সে এসে রান্নাঘরের দরজায় উঁকি মেরে বলল, ‘জয় হোক বাবা! আপনাদের খেয়ে-দেয়ে কিছু থাকলে আমি বুড়োে ভিখারি কিছু খেতে পাব কি?’

 জমিদারমশায় বললেন, ‘অবশ্যি পাবে। রান্নাঘরের দাওয়ায় একটু বোসো।’

 জানালার পাশে একজন লোক বসেছিল। খানিক পরে সে চেঁচিয়ে উঠল ‘আরে মস্ত বড় একটা খরগোশ ছুটে বাগানের দিকে যাচ্ছে- এটাকে মারলে হয় না?’

 জমিদার ধমক দিয়ে বললেন, ‘খরগোশ মারবার ঢের সময় মিলবে, এখন চুপ করে বসে থাকো।’

 খরগোশটা বাগানে গিয়ে ঢুকল। ভিখারি পোশাক-পরা চানু থলের ভিতর থেকে আরএকটা খরগোশ ছেড়ে দিল। একটু পরেই চাকর আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাবু বাবু খরগোশটা এখনো রয়েছে-এখনো চেষ্টা করলে মারা যায়।’

 আবার জমিদার ধমক দিলেন, ‘চুপ করে থাকো বলছি।’

 খানিক বাদে চানু আরো একটা খরগোশ থলে থেকে বের করে ছেড়ে দিল। চাকরও চেঁচিয়ে উঠল। —আর যায় কোথা! একজন একজন করে সবকটি চাকর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে খবগোশের পেছনে তাড়া কবল, জমিদারমশায়ও বাদ পড়লেন না।

 খরগোশ তাড়িয়ে সকলে ফিরে এসে দেখে ভিখারিও নেই, কড়ার মধ্যে হাঁসও নেই। জমিদারমশাই বললেন, ‘আচ্ছা ফাঁকিটা দিয়েছে চানু, সত্যি সত্যি আমাকে জব্দ করেছে।’

 একটু পরেই চানুদের বাড়ি থেকে একজন চাকর এসে জমিদারমশায়কে বলল, ‘আজ্ঞে, আমার মনিব বলে পাঠিযেছে, আপনারা অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়ি গিয়ে খাবেন।’

 জমিদার বড় চমৎকার সাদাসিধে লোক ছিলেন, মনে একটুও অহংকার ছিল না। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চানুদেব বাড়ি এলেন এবং সকলের সঙ্গে বসে নানারকম ভাল ভাল খাবার জিনিসের সঙ্গে তাঁর সেই হাঁস ভাজাটিও খেলেন। চানুর চালাকির কথা বলে জমিদারমশায় হাসতে হাসতে পাঁজরে ব্যাথা ধরিয়ে ফেললেন। মেয়েটি ত আগে থেকেই চানুকে পছন্দ করত, এখন তার পোশাক দেখে এবং তার আদবকায়দা দেখে মনে মনে আরো খুশি হল।

 খাওয়া দাওয়ার পর জমিদার বললেন, ‘চানু, শুধু হাঁস চুরি করেই আমার মেয়ে পাবে না। কাল রাত্রে আমার আস্তাবল থেকে আমার ছয়টি ঘোড়া যদি চুরি করতে পার তা হলে দেখা যাবে এখন। ছজন সহিস কিন্তু ছয়টি ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাহারা দেবে মনে রেখো।’

 চানু বলল, ‘আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখব এখন।’

 সোমবার রাত্রে জমিদারের আস্তাবলে ছয়জন সহিস ছয়টি ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। বেজায় ঠাণ্ডা, রক্ত যেন জমে যেতে চায়;তাই প্রত্যেকের জামার পকেটে একটি করে মদের বোতল, খানিক পরে পরে একটু করে মদ খেয়ে গা গরম করে নিচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না, তাই সকলে মিলে মহা গল্প জুড়ে দিল—চানুর জন্য আস্তাবলের দরজা খোলাই রেখেছিল। রাত যত বেশি হতে লাগল ঠাণ্ডাটাও যেন বাড়তে লাগল। মদে আর শানায় না, গায়ে কাঁপুনি ধরে গেল এমন সময় ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে একটা কদাকার বুড়ো এসে দরজায় উঁকি মেরে বলল, বাবাসকল, শীতে জমে গেলাম, এক মুঠো খড় দাও ত, আস্তাবলের এককোণে রাতটা পড়ে থাকি, তা না হলে বুড়ো মানুষ—শীতে মরেই যাব। বুড়োর পিঠে ছয়টা থলে, মুখে প্রায় দু আঙ্গুল লম্বা দাড়ি—চেহারাটি কুৎসিতের একশেষ।