পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৪৩৫

জোলাকে বিছানায় শোয়াইয়া কাপড় চাপা দিয়া সে কাঁদিতে বসিল। এর মধ্যে আর দুচারজন জোলা বেড়াইতে আসিয়া দেখে যে, জেলার স্ত্রী কাঁদিতেছে। তারপর জিজ্ঞাসা করিয়া যখন জানিল যে, লাল সূতা নীল সূতা পাওয়া গিয়াছে, তখন সকলে স্থির করিল যে, জোলা নিশ্চয় মরিয়া গিয়াছে। সুতরাং তাহার সুৎকারের চেষ্টা দেখিতে লাগিল।

 কিন্তু ইহার মধ্যে ভারি মুশকিল দেখা দিল। পোড়ানোতে জোলা কিছুতেই রাজি নয়। পোড়ানোর কথা তুলিতেই সে বলে, ‘ওমা! পুড়ে যাব যে!’ মরিয়া গেলে তাকে পোড়ানো ছাড়া আর কি করা যায়? —গোর দেওয়া! কিন্তু জোলা তাহাতেও অসম্মত। বলে, ‘ওমা! দম আটকে যাবে যে!’ শেষে অনেক যুক্তির পর স্থির হইল যে, জোলাকে গোর দেওয়াই হইবে, কিন্তু মুখখানা জাগাইয়া রাখা যাইবে। জোলা তাহাতে রাজি হইল; কিন্তু সে বলিল যে ‘খিদে পেলে চারটি ভাত দিয়ো।’ এইরূপ পরামর্শের পর জোলাকে গোর দেওয়া হইল; অর্থাৎ তাহার মুখ জাগিয়া রহিল, আব-সব মাটি দিয়া ঢাকিয়া দিল।

 এইরূপে সমস্ত দিন চলিয়া গেল। রাত্রিতে চারটি ভা৩ খাইয়া জোলা একটু নিদ্রার চেষ্টা দেখিল।

 সেই বাত্রিতে সাত চোর রাজার বাড়িতে চুরি করিতে চলিয়াছে। চোরেরা ত আর বাবুদের মতন সদর রাস্তা দিয়ে চলে না—তাহা প্রায়ই ঝোপজঙ্গলের ভিতর দিয়া চলে, আর সে-সব জায়গা অনেক সময়ই নোংরা থাকে। চলিতে চলিতে একজন চোর কাদার মতন একটা কি জিনিস মাড়াইল, সে জিনিসটার বিশ্রী গন্ধ। সে পা মুছিবার জন্য একটা জায়গা খুঁজিতে লাগিল। উহার নিকটেই জোলাকে গোর দিয়াছে, সে চোর পা মুছিবি ত মোছ, সেই জোলার মুখে গিয়া মুছিতে লাগিল! ঘষার আর গন্ধে র চোটে জোলার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল; সে রাগিয়া বলিল, ‘উঃ—হুঁঃ—হুঁঃ— তোমার কি চোখ নাই না কি?’

 চোর আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কে রে?

 জোলা বলিল, ‘আমি জোলা।’

 ‘এখানে কি করছিস?’

 ‘আমি যে মরে গিয়েছি;আমার লাল সুতো নীল সুতো বেরিয়েছে—তাই আমাকে গোর দিয়েছে।’

 এই কথা শুনিয়া চোরেরা খুব হাসিতে লাগিল। তারপর তাহাদের একজন বলিল, ‘একে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চল।’

 চোররা জোলাকে বুঝাইয়া দিল যে, তাহার মৃত্যু হয় নাই, আর তাহাদের সঙ্গে গেলে পেট ভরিয়া খাইতে পারিবে। জোলা জিজ্ঞাসা করিল, কি খাওয়াবে? পায়েস? ‘চোরেরা বলিল, ‘হ্যাঁ, পায়েস—চল্’ পায়েসের কথা শুনিয়া জোলা কোন আপত্তি করিল না। চোরেরা তাহাকে উঠাইয়া লইয়া চলিল।

 রাজার বাড়িতে গিয়া চোরেরা রাজার ঘরে প্রকাণ্ড সিঁদ কাটিল! তারপর জোলাকে ঐ সিঁদের ভিতর ঢুকাইয়া দিয়া বলিল, রাজার মাথার মুকুটটা নিয়ে আয়।’ রাজার খাটে মশারি খাটানো ছিল, তাহা দেখিয়া জোলা ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল। সে মশারির চারিদিক ঘুরিয়া কোথাও তাহার দরজা দেখিতে পাইল না; সুতরাং চোরেদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিল,‘ হল না; ওর ভিতরে আর একটা ঘর আছে, তার দরজা নেই।’