পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৪৪৭

 ঊনা সেদিকে দেখল, সত্যি সত্যিই কুঁকড়ো আসছে, কিন্তু এখনো সে ঢের দূরে, তিন-চার দিনের কমে এসে পৌঁছবে না। তখন সে ফিঙেকে বলল, ‘তোমার কোন ভয় নেই। তুমি পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকো, আমি কুঁকড়োকে ঠিক করে দিচ্ছি।’ কিন্তু ফিঙের মনের ভয় তাতে গেল না। সে মাথা হেঁট করে বসে কত কথাই ভাবতে লাগল।

 ঊনা কিন্তু ততক্ষণে চুপ করে ছিল না। সে গ্রামের লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যার ঘরে যত ভাঙা দা, কুড়ুল, কাস্তে, খন্তা, কোদাল, হুড়কো ছিটকিনি আর হাতুটি আর পেরেক ছিল, সব চেয়ে ঝুড়ি ভরে নিয়ে এল। তারপর সেইগুলো ভিতরে পুরে পুরে সে দুদিন ধরে খালি পাটিসাপটাই তয়ের করল। ফিঙে অবাক হয়ে চেয়ে দেখে, আর বলে, ‘ও কি করছ?’ ঊনা বলে, ‘যাই করি না কেন —তুমি চুপ করে থাকো।’

 পিঠে হয়ে গেলে উনা তিন গামলা ছানা ও তয়ের করল। তারপর ফিঙেকে অনেক পরামর্শ দিয়ে, অনেক সন্ধান শিখিয়ে রেখে, সে সব ঠিকঠাক করে রাখল। এখন কুঁকড়ো এলেই হয়।

 পরদিন দুপুরবেলায় কুঁকড়ো এসে উপস্থিত হয়েছে। এসেই ভয়ংকর গর্জনে আকাশপাতাল কাঁপিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ফিঙে কোথায়?’ উনা বলল, ‘সে ত বাড়ি নেই। কুঁকড়ো বলে নাকি একটা ছোকরা তাকে খুঁজতে সমুদ্রের ধারে গিয়ে ভারি বড়াই করছিল, তাই শুনে ফিঙে বিষম রেগে লাঠি হাতে তাকে মারতে বেরিয়েছে। যদি তাকে দেখতে পায় তবে আর বেচারাকে আস্ত রাখবে না।’

 তা শুনে কুঁকড়ো ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমি ত কুঁকড়ো, তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছি।’ এ কথায় ঊনা হো হো করে হেসেই কুটিপাটি। তারপর অনেকক্ষণ নাক সিঁটকিয়ে কুঁকড়োর পানে তাকিয়ে থেকে সে বলল, ‘এই টিকটিকির মত জোয়ানটি হয়ে তুমি ফিঙের সঙ্গে যুদ্ধ করবে? অমনি কাজও করতে নাই বাছা। কেন ফিঙের হাতে প্রাণ দেবে? আমার কথা শুনে চলো, আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। ততক্ষণ একটা কাজ কর দেখি; বড্ড হাওয়া আসছে, ফিঙে বাড়ি নেই, কে ঘরখানিকে ঘুরিয়ে দেবে? দেখো ত তুমি পার কিনা।’

 কুঁকড়ো ভাবল, ‘বাবা। হাওয়া থামাতে হলে ফিঙে এই ঘরটাকে ঘুরিয়ে দেয় নাকি? এখন আমি যদি “না” বলি তবে ত দেখছি আমার বড় নিন্দে হবে।’ তখন সে আগে খুব করে তার ডান হাতের মাঝের আঙুলটা মটকে নিল। আঙুলটাতেই তার যত জোর ছিল, ওটি না হলে সে কিছুই করতে পারত না। আঙুল মটকানো হয়ে গেলে সে দুহাতে ঘরখানিকে জড়িয়ে ধরে তাতে এমন পাক দিল যে দেখতে দেখতে পাহাড়ের চূড়া সুদ্ধ ঘরখানি ঘুরে গেল।

 এতক্ষণ ফিঙে কি করছে? সে ঊনার পরামর্শে তার নিজের খোকা সেজে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আর কুঁকড়োর কাণ্ড দেখে সেই কাথার ভিতরে ভয়ে ঘেমে আর কেঁপে অস্থির হচ্ছে।

 এদিকে ঊনা আবার কুঁকড়োকে বলল, ‘বেশ বাপু! লক্ষ্মী ছেলে তুমি। আহা! ঘরে এক ফোঁটা জল নেই, তোমাকে কি দিয়ে একটু মেঠাই খেতে দিই। পাহাড়টার নীচে জল থাকে। ফিঙে পাহাড় সরিয়ে তাই তুলে আনে। আজ ত সে বাড়ি নেই, এখন উপায় কি হবে? দেখো ত বাপু তুমি পাহাড়টা ঠেলে, একটু জল আনতে পার কি না!’