পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৪৭৯

দানব, যক্ষ, রাক্ষস, জীবজন্তুর সহিত সকল সৃষ্টি সেই আগুনে পুড়িয়া নষ্ট হইল।

 তারপর আসিল মেঘ। লাল মেঘ, নীল মেঘ, কালো মেঘ, হাতির মত মেঘ, পর্বতের মত মেঘ। তখন বিদ্যুতের ঝিকিমিকি আর বজ্রপাতের ঘোরতর শব্দে আকাশ পাতাল তোলপাড় করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। সেই বৃষ্টি দেখিতে দেখিতে সেই ভীষণ আগুন নিভাইয়া, পাহাড় পর্বত তল করিয়া দিল। বার বৎসরের মধ্যে আর সেই সাংঘাতিক বৃষ্টির বিরাম হইল না। তারপর যখন ঝড়-বৃষ্টি থামিল, তখন দেখা গেল যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জলে ডুবিয়া গিয়াছে, জল ভিন্ন জগতে আর কিছুই নাই।

 এত কাণ্ডের ভিতরে মার্কণ্ডেয় মুনি কি করিয়া বাঁচিয়া রহিলেন, তাহা জানি না, কিন্তু তিনি মরেন নাই। যাহা হউক, ক্ষুধায় ভুগিয়া, আগুনে পুড়িয়া, আর জলে ভাসিয়া, তাঁহার নিতান্তই ক্লেশ আর অসুবিধা হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ কি? সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এই বিপদের সময় তিনি একটা অতি বিশাল বটগাছ দেখিতে পাইলেন। সেই বটগাছের নিকট গিয়া তিনি দেখিলেন যে, তাহার ডালের উপর একখানি খাট, তাহাতে চমৎকার বিছানা, আর সেই বিছানার উপরে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল পরম সুন্দর একটি নীলবর্ণ বালক বসিয়া আছেন।

 এত আশ্চর্য ঘটনার ভিতর দিয়া আসিবার পরেও এই ঘটনাটি মার্কণ্ডেয়ের নিকট বড়ই আশ্চর্য বোধ হইল, এত কাণ্ড হইয়া গেল, চরাচর লণ্ডভণ্ড হইল, তথাপি এই বালক কি করিয়া রক্ষা পাইল? মার্কণ্ডেয় ত্রিকালজ্ঞ (অর্থাৎ গত কাল, উপস্থিত কাল আর যে কাল আসছে, এই তিন সময়ের কথাই যে জানে) হইয়াও এই প্রশ্নের উত্তর ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলেন না।

 সেই বালক কিন্তু মার্কণ্ডেয়কে দেখিয়া কিছুমাত্র চিন্তিত হইলেন না। তিনি তাঁহাকে দেখিবামাত্রই বলিলেন—

 “মার্কণ্ডেয়, তোমার বড়ই পরিশ্রম হইযাছে? আইস, আমার পেটের ভিতরে আসিয়া বিশ্রাম কর!”

 এই বলিয়া বালক হাঁ করিলেন, আর মার্কণ্ডেয় তাঁহার পেটের ভিতর ঢুকিয়া গেলেন!

 কিন্তু কি আশ্চর্য! বালকের পেটের মধ্যে গিয়া, মার্কণ্ডেয় কোথায় হজম হইয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হইবেন, না, তাহার বদলে তিনি দেখেন যে, তিনি পরম সুখে এই পৃথিবীতেই ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন! সেই হিমালয়, সেই গঙ্গা, সেই-সকল গ্রাম, নগর আর তীর্থস্থান, সেই লোকজন, সেই হাট-বাজার, সেই সংসার যাত্রার সকল আয়োজন ও আনন্দ।

 হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া মার্কণ্ডেয় সেই নিতান্ত অদ্ভুত বালকের পেটের ভিতরে বাস করিলেন, কিন্তু তাহার শেষ কোথাও খুঁজিয়া পাইলেন না। এত ঘটনার পরে, তাঁহার মনে হইল, ‘হয়ত বা এই বালক একটা কেহ হইবে।’ তখন তিনি তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিবামাত্র দেখেন যে, তিনি হঠাৎ বালকের পেটের ভিতর হইতে বাহিরে চলিয়া আসিয়াছেন, আর বালকটি যেমন ছিলেন, তেমনিই সেই বটগাছের ডালে খাটের উপরে বসিয়া আছেন। মার্কণ্ডেয়কে বাহিরে আসিতে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—“মার্কণ্ডেয়, বিশ্রাম ভালরূপ হইল ত?”

 তারপর মার্কণ্ডেয় জানিতে পারিলেন যে, এই বালক আর কেহ নহেন, স্বয়ং নারায়ণ।