পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৪৮৯

 সুতরাং দেবতারা যে সঞ্জীবনী বিদ্যায় সস্তুষ্ট না থাকিয়া অমর হইবার উপায় খুঁজিবেন, ইহা কিছুমাত্র আশ্চর্য নহে। অমর হইবার ঔষধ অমৃত। এই অমৃত খাইয়া অমর হইবার জন্য, দেবতাদিগের মনে বড়ই ইচ্ছা হইল।

 তাই তাঁহারা, সুমেরু পর্বতের উপর বসিয়া, পরামর্শ করিতে লাগিলেন যে, কি উপায়ে এই অমৃত পাওয়া যাইতে পারে। তাঁহাদিগকে এইরূপ পরামর্শ করিতে দেখিয়া নারায়ণ ব্রহ্মাকে বলিলেন, “দেবতা আর অসুরগণ একত্র হইয়া যদি সমুদ্র মন্থন করেন, তবে তাহা হইতে অমৃত উঠিবে।”

 এ কথায় ব্রহ্মা দেবগণকে ডাকিয়া বলিলেন, “হে দেবতাগণ। তোমরা সমুদ্র মন্থন কর, অমৃত পাইবে। অল্প মন্থন করিয়াই ক্ষান্ত হইও না; অতিশয় পরিশ্রম হইলেও ছাড়িয়া দিও না, ধনরত্ন বিস্তর পাইলেও মন্থন বন্ধ করিও না। ক্রমাগত কেবলই মন্থন করিতে থাক, নিশ্চয় অমৃত পাইবে!”

 ব্রহ্মার কথা শুনিয়া সকলেই আনন্দিত হইলেন। তখনই সকলে ‘আইস!’ ‘কোম বাঁধ!’ ‘মন্থন বাড়ি আন!’ ‘মন্থন দড়ি খুঁজিয়া বাহির কর।’ এই বলিয়া সমুদ্র মন্থনের আয়োজনের তাড়া পড়িল।

 সমুদ্র মন্থন হইবে, তাহার মতন মন্থন বাড়ি চাহি! যে সে মন্থন-বাড়িতে একাজ চলিবে না। বাঁশে হইবে না, তালগাছে কুলাইবে না। আরো অনেক লম্বা, অনেক হাজার যোজন লম্বা মন্থন-বাড়ি চাহি।

 এত বড় মন্থন-বাড়ি আর কিসে হইতে পারে? এক মন্দর পর্বতখানি আছে, তাহা বাইশ হাজার যোজন লম্বা। সেই মন্দর পর্বতকে দিয়াই মন্থনবাড়ি করিতে হইবে।

 সে পর্বত বাইশ হাজার যোজন লম্বা। এগার হাজার যোজন মাটির নীচে, এগার হাজার যোজন উপরে। বন জঙ্গল, বাঘ ভাল্লুক, গন্ধর্ব কিন্নর সুদ্ধ, সেই বিশাল পুরানো পর্বত তুলিতে দেবতাদিগের কিছুতেই শক্তি হইল না। অনেক পরিশ্রম, অনেক টানাটানি করিয়া, শেষে তাঁহারা হেঁট মুখে ব্রহ্মা ও নারায়ণের নিকট গিয়া, জোড়হাতে বলিলেন, “প্রভো, আমরা ত পর্বত উঠাইতে পারিলাম না। দয়া করিয়া ইহার উপায় করুন!”

 ইহা শুনিয়া নারায়ণ সর্পরাজ অনন্তকে বলিলেন, “অনন্ত, তুমি এই পর্বত উঠাইয়া দাও।”

 অনন্ত এই পৃথিবীটাকে মাথায় করিয়া রাখেন, তাঁহার পক্ষে একটা পর্বত উঠান কি কঠিন কাজ? নারায়ণের অনুমতি মাত্রই তিনি সেই বিশাল পর্বত তুলিয়া আনিলেন। তাঁহার কিছুমাত্র কষ্ট হইল না।

 তারপর সেই পর্বত লইয়া আর অনন্তকে সঙ্গে করিয়া দেবতা ও অসুরগণ সমুদ্রের তীরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। মন্থন-দড়ির জন্য কোন চিন্তা করিতে হইল না। অনন্ত সর্প অতিশয় লম্বা আর তাঁহার শরীর বড়ই মজবুত, তিনি বললেন, “আমিই দড়ি হইব!”

 কিন্তু সমুদ্রের তলায় কাদা, তাহাতে পর্বত বসাইয়া পাক দিলে তলায় ছিদ্র হইয়া যাইবে! হয়ত সেই ছিদ্রে পর্বত আঁটিয়া যাইবে—তারপর আর তাহাতে পাক দেওয়া যাইবে না! সুতরাং কিসের উপরে পর্বত রাখা যায়?

 অনন্ত পৃথিবীকে মাথায় রাখেন। সেই পৃথিবীসুদ্ধ সেই অনন্তকে কচ্ছপের রাজা পিঠে করিয়া রাখেন, তাঁহার পিঠের খোলা বড়ই কঠিন।

উপেন্দ্র--৬২