পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫১১

 কিন্তু আর দুঃখ করিয়া কি ফল হইবে? শৃঙ্গী শাপ দিয়া বসিয়াছেন, এখন আর পরীক্ষিতের রক্ষা নাই। তথাপি শমীক মনে করিলেন যে, অন্তত এই সংবাদ রাজাকে জানাইয়া তাঁহাকে সতর্ক করিয়া দিলে কিছু উপকার হইতে পারে। সুতরাং তিনি, গৌরমুখ নামক একজন শিষ্যকে দিয়া এই সংবাদ পরীক্ষিতের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।

 গৌরমুখের নিকট সকল কথা শুনিয়া, পরীক্ষিতের বড়ই অনুতাপ হইল। কিন্তু তিনি নিজের মৃত্যুর কথা মনে করিয়া তত দুঃখিত হইলেন না, যত সেই মুনির কথা ভাবিয়া হইলেন। তিনি কেবল ইহাই বলিতে লাগিলেন, “আমি তাঁহার এত অপমান করিলাম, তথাপি তিনি আমাকে ক্ষমা করিলেন! হায়! এমন মহাপুরুষের অপমান করিয়া আমি কি কুকর্মই করিয়াছি।”

 যাহা হউক, এই বিষম বিপদ হইতে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় আছে কি না, পরীক্ষিৎ তাহার কথা ভাবিতে ভুলিয়া গেলেন না। মন্ত্রীদিগকে লইয়া তিনি এ বিষয়ে অনেক পরামর্শ করিলেন। তারপর রাজ্যের বড়বড় রাজমিস্ত্রী-দিগকে ডাকিয়া আনা হইল। তাহারা খুব মজবুত একটা থাম খাড়া করিয়া, তাহার আগায়, রাজার থাকিবার জন্য পায়রার ঘরের মত (অবশ্য, তার চেয়ে ঢের বড়) একটি ঘর প্রস্তুত করিয়া দিল। সেই ঘরে রাজা বড় বড় রোজা আর বদ্যি আর রাশি রাশি ঔষধ লইয়া অতি সাবধানে বাস করিতে লাগিলেন। বিনা অনুমতিতে কাহারই তাঁহার নিকট যাইবার উপায় রহিল না। থামের চারিধারে দিনরাত হাতিয়ার বাঁধা সিপাইরা পাহারা দিতে লাগিল পিপীলিকারও সাধ্য ছিল না যে, তাহাদিগকে ফাঁকি দিয়া উপরে যায়।

 সেকালে কাশ্যপ নামক এক মুনি, সাপের বিষের অতি আশ্চর্যরকম চিকিৎসা জানিতেন। পরীক্ষিৎকে সাপে খাইবে এই সংবাদ শুনিয়া, তিনি মনে করিলেন, ‘ইঁহাকে বাঁচাইতে পারিলে আমি নিশ্চয়ই অনেক টাকা পুরস্কার পাইব।’ এই মনে করিয়া তিনি তাঁহার চিকিৎসা করিবার জনা হস্তিনায় যাত্রা করিয়াছেন, এমন সময়ে একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সহিত তাঁহার দেখা হইল। এই ব্রাহ্মণ আর কেহ নহে, তক্ষকই ব্রাহ্মণের বেশ পরিয়া রাজাকে সংহার করিতে যাইতেছে।

 কাশ্যপকে দেখিয়া তক্ষক জিজ্ঞাসা করিল, “কি মুনিঠাকুর, এত তাড়াতাড়ি কোথায় চলিয়াছেন?”

 কাশ্যপ কহিলেন, “রাজা পরীক্ষিৎকে আজ তক্ষকে কামড়াইবে, আমি তাঁহাকে বাঁচাইতে যাইতেছি।”

 তক্ষক বলিল, “মহাশয়, আমি সেই তক্ষক। আপনি মিছামিছি এত পরিশ্রম কেন করিতেছেন? ঘরে ফিরিয়া যাউন। আমি কামড়াইলে আপনার সাধ্য নাই যে, তাহাকে রক্ষা করেন।”

 কাশ্যপ কহিলেন, “আমি নিশ্চয়ই তাঁহাকে বাঁচাইতে পারিব, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।”

 তক্ষক বলিল, “যদি আপনার এমন ক্ষমতাই থাকে তবে আমি এই বটগাছটাকে কামড়াইতেছি, ইহাকে বাঁচাইয়া দিন ত দেখি!”

 কাশ্যপ কহিলেন, “আচ্ছা, তুমি কামড়াও ত!”