পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫১৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

এইরূপ কথাবার্তার পর জরৎকারুর সহিত বাসুকির ভগিনীর বিবাহ হইল। ইহাদের পুত্রই আস্তিক, যিনি সর্পগণকে জনমেজয়ের যজ্ঞ হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন।

 আস্তিকের জন্মের কয়েকদিন আগে জরৎকারু তাহার স্ত্রীর উপর রাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। বেচারীর কোন দোষ ছিল না। তিনি পরম যত্নে স্বামীর সেবা করিতেন।

 একদিন বিকাল বেলায় জরৎকারু মুনি নিদ্রা গেলেন ক্রমে সূর্যাস্ত আসিয়া উপস্থিত হইল, সন্ধ্যাকালে উপাসনার (ভগবানের পূজার) সময় হইল, তথাপি মুনির ঘুম ভাঙ্গিল না। ইহাতে তাঁহার স্ত্রী ভাবিলেন, “এখন কি করি? ঘুম ভাঙ্গাইলে হয়ত ইঁহার রাগ হইবে, আর সন্ধ্যাপূজা না করা হইলে ইঁহার পাপ হইবে।” অনেক ভাবিয়া তিনি স্থির করিলেন, “যাহাতে ইঁহার পাপ হয়, এ-সব ঘটনা হইতে দেওয়া উচিত নহে, সুতরাং ইঁহাকে জাগানই কর্তব্য।” এই মনে করিয়া যেই তিনি মুনিকে আস্তে আস্তে জাগাইয়াছেন; অমনি মুনি রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “কি? আমাকে অপমান করিলে? এই আমি চলিলাম—আর এখানে কিছুতেই থাকিব না।”

 ইহাতে বাসুকির ভগিনী নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বিনয়ের সহিত বলিলেন, “ভগবন্, সূর্যাস্ত হইতেছিল, তাই সন্ধ্যাপূজার জন্য আপনাকে জাগাইয়াছিলাম। আপনাকে অপমান করিতে চাহি নাই।”

 জরৎকারু বলিলেন, “আমি ঘুমাইয়া থাকিতে কি সূর্যস্ত হইবার শক্তি আছে? কাজেই আমাকে জাগাইয়া আমার অপমান করিয়াছ। আমি আর এখানে থাকিব না।”

 এই বলিয়া মুনি সেখান হইতে চলিয়া গেলেন, তাহার স্ত্রীর চোখের জলের দিকে একবারও ফিরিয়া চাহিলেন না। ইহার কিছুদিন পরেই আস্তিকের জন্ম হইল! ছেলেটি দেখিতে দেবতার ন্যায় সুন্দর। আর তাহার এমন অসাধারণ বুদ্ধি যে, শিশুকালেই বেদ, পুরাণ সমস্ত পড়িয়া মুখস্থ করিয়া ফেলিল। তাহাকে পাইয়া নাগগণের আর আনন্দের সীমা রহিল না। উহারা কত যত্নের সহিত যে তাহাকে পালন করিতে লাগিল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।

 এই সময়েই জনমেজয়ের যজ্ঞ আরম্ভ হয়। যজ্ঞের সকল আয়োজন প্রস্তুত, সকলে তাহা আরম্ভ করিতে যাইতেছেন, এমন সময় সেখানে একটি লোক আসিল; তাঁহার চোখ দুইটা ভারি লাল! লোকটি স্থপতি বিদ্যায় (অর্থাৎ ঘর বাড়ি প্রস্তুত বিষয়ে) বড়ই পণ্ডিত। সে খানিক এদিক, ওদিক দেখিয়া, তারপর বলিল, “যে সময়ে আর যে স্থানে তোমরা যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছ তাহাতে আমার বোধ হয়; তোমরা ইহা শেষ করিয়া উঠিতে পারিবে না; এক ব্রাহ্মণ আসিয়া ইহাতে বাধা দিবে।” ইহা শুনিয়া জনমেজয় তখনই দারোয়ানদিগকে আজ্ঞা দিলেন যে, “আমাকে না জানাইয়া কাহাকেও ঢুকিতে দিবে না।”

 তারপর যজ্ঞ আরম্ভ হইল। পুরোহিতেরা কালোরঙের ধুতি চাদর পরিয়া মন্ত্র পড়িতে পড়িতে, আগুনে ঘি ঢালিতে লাগিলেন, ধোঁয়ায় তাহাদের চোখ লাল হইয়া উঠিল। সর্পগণের নাম লইয়া অগ্নিতে আহুতি পড়িবামাত্র (ঘৃত ঢালা হইবামাত্র) তাহারা বুঝিল যে, আর প্রাণের আসা নাই। অল্পক্ষণ পরেই দেখা গেল যে, নানারকম সাপ আসিয়া আগুনে পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। বেচারারা ভয়ে অস্থির হইয়া, ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে, বাঁচিবার জন্য কত চেষ্টাই করিতেছে, লেজ দিয়া আর মাথা দিয়া একজন আর একজনকে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরিতেছে। আর ক্রমাগত আপনার লোকদিগের নাম লইয়া চিৎকার পূর্বক কত যে