পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫২৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

তিনি সন্তুষ্ট হইয়া যযাতিকে বলিলেন, “মহারাজ, আমি আনন্দের সহিত অনুমতি দিতেছি, তুমি আমার কন্যাকে বিবাহ কর।”

 এইরূপে যযাতির সহিত দেবযানীর বিবাহ হইল। যযাতি তাঁহাকে লইয়া পরম আনন্দে নিজের দেশে চলিয়া আসিলেন।

 অবশ্য শর্মিষ্ঠা আর তাঁহার একহাজার সখীও যযাতির সহিত তাঁহার রাজধানীতে আসিলেন। শুক্র যযাতিকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিলেন, “সাবধান! শর্মিষ্ঠাকে তুমি বিবাহ করিতে পারিবে না।”

 রাজধানীতে পৌঁছিয়া দেবযানী রাজার বাড়ীতে রহিলেন, কিন্তু শর্মিষ্ঠাকে তিনি সেখানে থাকিতে দিলেন না। তাঁহার কথায় রাজা একটি অশোক বনের ভিতরে শর্মিষ্ঠার জন্য একটি বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিলেন।

 এইরূপে দিন যায়। ইহার মধ্যে একদিন কি হইয়াছে, শুন। শর্মিষ্ঠাকে যযাতি বিবাহ করিয়াছেন কিন্তু দেবযানীকে তাহা জানিতে দেন নাই। দেবযানীর দুই পুত্র তাহদের নাম যদু আর তুর্বসু। শর্মিষ্ঠার তিনটি পুত্র, তাহদের নাম দ্রুহ্য, অনু আর পুরু। দেবযানীর পুত্রেরা রাজপুত্রের মতন পরম সুখে রাজ্যের ভিতরে চলাফেরা করে, তাহদের সম্মান আর আদরের সীমা নাই। শর্মিষ্ঠার ছেলে তিনটিকে, দেবযানীর ভয়ে, রাজা সেই অশোক বনের ভিতরেই লুকাইয়া রাখিয়াছেন, তাহাদিগকে বাহিরে আসিতে দেন না। ছেলে কয়টি আশপাশের বনে খেলা করিয়া বেড়ায়। বাহিরের লোক তাহাদিগকে দেখিতেও পায় না, কাজেই তাহাদের কথা জানেও না।

 একদিন দেবযানী রাজার সঙ্গে বনের ভিতরে বেড়াইতে গিয়া সেই ছেলে তিনটিকে দেখিতে পাইলেন। এমন সুন্দর ছেলে তিনটি বনের ভিতরে কোথা হইতে আসিল? দেখিতে রাজপুত্রের মতন অথচ তাহদের সঙ্গে লোক জন নাই। এ-সকল কথা ভাবিতে ভাবিতে সকলেরই আশ্চর্য বোধ হয়, আর তাহদের পরিচয় লইতে ইচ্ছা করে। দেবযানী তাহাদিগকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা তোমরা কে? তোমাদের পিতার নাম কি?”

 এ কথায় ছেলে তিনটি পরম আহ্লাদের সহিত যযাতিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, “এই আমাদের বাবা! আমাদের মার নাম শর্মিষ্ঠা।”

 এই বলিয়া তাহারা হাসিতে হাসিতে যযাতির নিকট ছুটিয়া আসিল, কিন্তু যযাতি দেবযানীর ভয়ে যেন তাহাদিগকে চিনিতেই পারিলেন না। ইহাতে ছেলে তিনটি অভিমানে ঠোঁট ফুলাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তাহদের মায়ের নিকট চলিয়া গেল।

 ইহার পর আর দেবযানীর জানিতে বাকি রহিল না যে, রাজা লুকাইয়া শর্মিষ্ঠাকে বিবাহ করিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার মনে কি যে কষ্ট হইল, তাহা কি বলিব। তাঁহার বিশাল সুন্দর চক্ষু দুইটি জলে পরিপূর্ণ হইয়া গেল, তিনি আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব না করিয়া, “মহারাজ, এই আমি চলিলাম” বলিয়া তখনই তাঁহার পিতার নিকট যাত্রা করিলেন।

 রাজা নিতান্ত দুঃখের সহিত তাঁহাকে নানারূপ মিনতি করিতে করিতে তাঁহার পিছু পিছু চলিলেন, কিন্তু দেবযানী কিছুতেই ফিরিলেন না। তিনি রাজাকে ভালো মন্দ কিছু না বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে একেবারে শুক্রাচার্যের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। রাজাও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়া জোড়হাতে দাড়াইয়া রহিলেন।