পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫২৯

 আহা! মা হইয়া কি এমন নিষ্ঠুর কাজ করে? খুকিটির মুখখানি এতই সুন্দর ছিল যে, তাহার দিকে একবার চাহিয়া দেখিয়া বনের পাখিরাও তাহাকে ভালো না বাসিয়া থাকিতে পারিল না। তাহারা বনের পাখি, মানুষের ছানাকে কি খাওয়াইতে হয়, তাহা তাহারা জানে না। তাহারা খালি খুকিটির চারি ধারে বসিয়া তাহাকে পাহারা দিতে লাগিল, আর ডানা দিয়া তাহাকে সূর্যের তাপ হইতে বাঁচাইয়া রাখিল।

 এমন সময় মহামুনি কন্ব সেই নদীতে স্নান করিতে আসিলেন। ধার্মিক তপস্বীরা পশুপক্ষীকে পর্যন্ত কত দয়া করেন, এমন খুকিটিকে দেখিয়া তাঁহার প্রাণ স্নেহে গলিয়া যাইবে, ইহা আশ্চর্য কি? তিনি তাহাকে বুকে করিয়া পরম যত্নে নিজের আশ্রমে লইয়া আসিলেন। নিজের সন্তান ছিল না, সেই খুকিটিকে তিনি তাঁহার প্রাণের সমস্ত স্নেহ দিয়া, মনে ভাবিলেন, যেন সেই তাঁহার সন্তান।

 পাখিরা তাহকে পালন করিয়াছিল, এই জন্য কন্ব সেই কন্যাটির নাম রাখিলেন, শকুন্তলা (শকুন্ত=পক্ষী)। শকুন্তলা যখন কথা কহিতে শিখিল তখন কন্বকে সে ‘বাবা’ বলিয়া ডাকিতে লাগিল। সে জানিত যে, মুনিই তাহার পিতা।

 সেই মেয়েটিকে পাইয়া না জানি মুনির প্রাণে কতই আরাম বোধ হইয়া ছিল। তাহার সুন্দর মুখখানির দিকে তাকাইলেই তাঁহার আনন্দ উথলিয়া উঠিত। মেয়েটির এমন বুদ্ধি যে, তাহাকে কিছুই বলিয়া দিতে হইত না। সে তাহার দুটি খুরখুরে পায় ছুটাছুটি করিয়া, আর তাহার ছোট ছোট হাত দুখানি নাড়িয়া মুনির ঘর ঝাঁট দেওয়া হইতে ফুল তুলিয়া আনা অবধি, এত কাজ করিয়া রাখিত যে, তাহা যে দেখিত, সেই আশ্চর্য হইয়া যাইত।

 বনের যত হরিণ, আর পাখি, তাহারা ছিল শকুন্তলার খেলার সঙ্গী। তাহারা তাহাকে দেখিলেই ছুটিয়া আসিত। শকুন্তলা তাহাদিগকে খাবার দিয়া তাহাদের গায়ে হাত বুলাইয়া দিত, তাহারাও শকুন্তলার আঁচলে মাথা গুঁজিয়া খেলা করিত।

 এইরূপে বনের পশুপক্ষীর সঙ্গে খেলা করিয়া, আর কন্বের নিকট ভগবানের কথা শুনিয়া, শকুন্তলা ক্রমে বড় হইয়া উঠিল। মুনি ঋষি ছাড়া বাহিরে মানুষ তপোবনে প্রায় আসিত না। কাজেই শকুন্তলা তাহাদের কথা বেশি করিয়া জানিতেও পারিল না। তাহার জন্ম এবং শিশুকালের কথা কন্ব অন্যান্য মুনিদিগকে অনেক সময় বলতেন, সুতরাং সে-সকল কথা সে মোটামুটি জানিয়াছিল।

 ইহার মধ্যে একদিন সেই বনের ধারে হস্তিনার রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়া করিতে আসিলেন, সঙ্গে তাঁহার লোকজনের অন্ত ছিল না। তাহাদের কোলাহল শুনিয়াই বনের জন্তুদের প্রাণ উড়িয়া গেল। শুয়োর হরিণ যত ছিল, রাজা তাহার অনেকগুলিই মারিয়া ফেলিলেন। সবগুলিকে যে মারেন নাই, তাহা কেবল তাঁহার ভয়ানক পিপাসা হইয়াছিল বলিয়া।

 পিপাসায় অস্থির হইয়া, রাজা জল খুঁজিতে খুঁজিতে ক্রমে কন্বমুনির আশ্রমের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অতি সুন্দর আশ্রমটি। গাছের ছায়ায়, ফুলের গন্ধে আর পাখির গানে সেখানে গেলেই প্রাণ শীতল হইয়া যায়। মালিনী নদী তাহার নীচ দিয়াই কুল কুল শব্দে বহিয়া যাইতেছে। এমন সুন্দর নদী, এমন নির্মল জল, আর কোথাও নাই। জলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে নদীতে সাঁতার দিতেছে তাহাদের কলরব যেন সেতারের বাদ্য, এমনি মিষ্ট।

উপেন্দ্র—৬৭