পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৩৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 কি সর্বনাশ! হাজার বৎসরের বুড়া মুনি, তাহাকে আবার উইয়ে খাইয়া হাড় ক’খানি মাত্র বাকি রাখিয়াছে। সে কিনা বলে, “তোমার মেয়েকে বিবাহ করিব।” রাজা ত বড়ই সঙ্কটে পড়িলেন—এখন উপায় কি?

 উপায় আর কি হইবে? মেয়ে বিবাহ না দিলে মুনি কিছুতেই রাজার সৈন্যদিগকে ছাড়িতেছেন না। এতক্ষণে তাহারা অসুখের জ্বালায় আধপাগলা গোছের হইয়া উঠিয়াছে আর খানিক বাদে কি করিবে তাহার ঠিক নাই। কাজেই, রাজার বুক ফাটুক আর যাহাই হউক, মুনির কথায় তাঁহাকে রাজি হইতেই হইল।

 হায়! এমন আদরের ধন, তাহার কপালে কিনা এই ছিল! মা বাপের দুঃখ হইবে সে আর কতবড় কথা—রাজ্য সুদ্ধ লোক ইহাতে কাঁদিয়া অস্থির হইল।

 কিন্তু যাঁহার জন্য এত দুঃখ, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তাঁহাকে ইহাতে কিছুমাত্র দুঃখিত মনে হইল না। সুকন্যার মনের ভাব ছিল অন্যরূপ। তিনি মনে মনে ভাবিয়াছিলেন, ‘এত কষ্ট পাওয়ার পরেও যে মহাপুরুষ আমার সমস্ত দোষ ক্ষমা করিয়া আমাকে এমন স্নেহ দেখাইতে পারেন, তাঁহার সেবা করিয়া তাঁহাকে সুখী করাই হইতেছে আমার কাজ।’ সুতরাং তিনি এই ঘটনার দুঃখিত না হইয়া বরং আনন্দিতই হইলেন।

 এদিকে পণ্ডিতেরা পঞ্জিকা দেখিয়া বিবাহের শুভদিন স্থির করিয়াছেন; বিবাহের আয়োজনের ঘটা পড়িয়া গিয়াছে। তারপর শুভকার্য শেষ হইতেও আর অধিক বিলম্ব হইল না। বিবাহে ধুমধাম যে নিতান্ত কম হইয়াছিল তাহা নহে, কিন্তু আনন্দ আর কোথা হইতে হইবে? বিবাহের পর সুকন্যার কথা ভাবিয়াই সকলে দুঃখ করিতে লাগিল, কিন্তু সুকন্যা আনন্দের সহিত তপস্বিনীর বেশে, তাঁহার স্বামীর সহিত বনে চলিয়া গেলেন। সেখানে গিয়া স্বামীর সেবায় এবং ভগবানের চিন্তায় পরম সুখে তাঁহার দিন কাটিতে লাগিল।

 ইহার মধ্যে একদিন সুকন্যা স্নান করিয়া তাঁহাদের কুটীরের নিকট দাঁড়াইয়া আছেন, এমন সময় অশ্বিনীকুমার দুইভাই সেইখান দিয়া যাইতে ছিলেন। বনের ভিতরে এমন অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়েকে দেখিয়া অশ্বিনীকুমারদিগের আশ্চর্যের সীমা রহিল না। তাঁহারা সুকন্যার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভদ্রে, তুমি কে? এই বনের ভিতর কিজন্য আসিয়াছ?” সুকন্যা মাথা হেঁট করিয়া লজ্জিতভাবে বলিলেন, “ভগবন্‌, আমি রাজা শর্যাতির কন্যা; মহর্ষি চ্যবনের স্ত্রী।”

 এ কথায় অশ্বিনীকুমারেরা হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “না জানি তোমার পিতা কিরকম লোক, যে এই বুড়ার সঙ্গে তোমার বিবাহ দিলেন। তোমার মতন সুন্দরী মেয়ে স্বর্গেও দেখিতে পাওয়া যায় না। তোমাকে হীরা মুক্তায় জড়াইয়া রাখিলে তবে তোমার উপযুক্ত শোভা হয়। এই সামান্য ময়লা কাপড়খানি পরিয়া থাকা কি তোমার সাজে? আহা! তুমি এমন গরীবের হাতে পড়িয়াছ যে, তোমাকে ভাল করিয়া খাইতে পরিতে দিতে পারে না। এমন হতভাগ্য লোকের নিকট থাকিয়া কেন কষ্ট পাইতেছ? আমাদের একজনকে বিবাহ কর, স্বর্গে গিয়া পরম সুখে থাকিবে।”

 ইহাতে সুকন্যা আশ্চর্য এবং বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “মহাশয়, আমি আমার স্বামীকে অত্যন্ত ভালবাসি, এবং ভক্তি করি, আমার সাক্ষাতে এমন কথা মুখে আনিবেন না।”

 কিন্তু ইহাতেও অশ্বিনীকুমারদিগের ভদ্রতা শিক্ষা হইল না। তাঁহারা ফাঁকি দিয়া সুকন্যাকে