পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৪৯

পাখি ধরিতে গেলেন, অমনি দুষ্ট পাখির দল খিল খিল করিয়া হাসিতে হাসিতে কাপড়খানি লইয়া উড়িয়া পলাইল। যাইবার সময় বলিয়া গেল, “হাঃহাঃ! মহারাজ, চিনিতে পারিলে না? আমরা সেই পাশা! সব হারিয়া মনে করিয়াছিলে, বুঝি কাপড়খানি লইয়া পলাইবে? তা আমরা কাপড়খানি ছাড়িব কেন?”

 রাজা ভাবিলেন, ‘সময়ে সবই হয়,ইহার পর না জানি কি হইবে।’ ভাবিতে ভাবিতে তিনি দময়ন্তীর নিকট আসিয়া, তাহাকে বলিলেন, ‘দময়ন্তি, দুষ্টেরা আমার রাজ্য নিয়াছে, সর্বস্ব নিয়াছে। একখানিমাত্র কাপড় যে পরিয়াছিলাম, তাহাও তাহাদের সহ্য না হওয়াতে, আজ তাহাও লইয়া গেল! এখন আমি যাহা বলি শুন। দময়ন্তি, এই দেখ, কত পথ অবন্তী নগর ও ঋক্ষবান পর্বত হইয়া দক্ষিণ দেশে গিয়াছে। ঐ দেখ, বিন্ধ্য পর্বত, এই পায়োষ্ণী নদী। ঐ মুনিদিগের আশ্রম সকল দেখা যাইতেছে। এই পথে গেলে বিদর্ভ দেশে যাওয়া যায়; ঐ পথটি কোশলায় গিয়াছে।”

 বাজার কথায় দময়ন্তীর প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, “মহারাজ, না জানি তুমি কি মনে ভাবিয়া এ-সকল কথা বলিতেছ! তোমাকে ছাড়িয়া আমি কোথায় যাইব? শাস্ত্রে বলিযাছে, স্ত্রীই সকল দুঃখের ঔষধ; মহারাজ, তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিও না।” রাজা বলিলেন, “দময়ন্তি, আমি প্রাণত্যাগ করিতে পারি, তথাপি তোমাকে ছাড়িতে পারি না। তুমি ভয় পাইতেছ কেন।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “তবে কি জন্য বিদর্ভ দেশের পথ দেখাইয়া দিতেছ? মহারাজ, আমার বড়ই ভয় হইতেছে। যদি যাইতে হয়, চল না, দুজনেই বিদর্ভ দেশে যাই। বাবা তোমাকে বুকে করিয়া বাখিবেন।”

 নল বলিলেন, “না দময়ন্তী, এই বেশে আত্মীয়গণের নিকট যাইতে আমি কিছুতেই পারিব না।”

 এই বলিযা তিনি বারবার মিষ্ট কথায় দময়ন্তীকে শান্ত করিতে লাগিলেন। তারপর ক্ষুধা তৃষ্ণায় নিতান্ত কাতর হইয়া বনের এক গভীর স্থানে দুজনেই বিশ্রাম করিতে বসিলেন, অল্পক্ষণের ভিতরেই দময়ন্তীর নিদ্রা আসিল। কিন্তু নলের প্রাণে যে দুঃখের আগুন জ্বলিতে ছিল, তাহাতে নিদ্রা কি করিয়া আসিবে! এই দুঃখের ভিতরে দুষ্ট কলি ক্রমাগতই তাহার ভিতর হইতে বলিতেছিল, “দময়ন্তীকে সঙ্গে সঙ্গে লইয়া কেন কষ্ট দিতেছ? চলিয়া যাও! চলিয়া যাও’ দময়ন্তী তাহার বাপের বাড়ি গিয়া সুখে থাকুক!"

 নল বলিলেন, “যাইব? না, মরিব? যদি যাই, এই বেশে কি করিয়া যাইব? দময়ন্তীর কাপড়ের আধখানা কাটিয়া পরিয়া যাই। কিন্তু কি দিয়া কাটিব?”

 এই কথা মনে হইতে না হইতেই তিনি দেখিলেন, সামনে একখানি তলোয়ার, পড়িয়া আছে! সকলই দুষ্ট কলির কাজ, কিন্তু নল তাহা বুঝতে পারিলেন না! তিনি সেই তলোয়ার দিয়া দময়ন্তীর কাপড়ের অর্ধেক কাটিয়া পরিলেন। তখন কলি ক্রমাগত বলিতে লাগিল, “চল! চল!” তিনি তাহার কথায় কয়েক পা চলিয়া গেলেন, কিন্তু তাহার প্রাণের ভিতরে হায়, হায়! শব্দ উঠাতে আবার ফিরিয়া আসিলেন!

 এইরূপে কলি কতবার তাহাকে টানিল, কতবার তিনি আবার ফিরিলেন। একবার তাহার মনে হইল, হায়! আমার দময়ন্তীর এই দশা!’ একবার ভাবিলেন, ‘হায়! এই ভয়ংকর বনে