পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৫০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

আমার দময়ন্তী কি করিয়া থাকিবে?’ এমনি এক-এক কথা ভাবিয়া রাজা এক-একবার ফিরেন, আবার কলি তাহাকে টানিয়া লইয়া যায়। শেষে কলিরই জয় হইল, নল চোখের জলে ভাসিয়া বারবার দময়ন্তীর দিকে ফিরিয়া চাহিতে চাহিতে পাগলের মত ছুটিয়া পলাইলেন।

 আহা, দময়ন্তীকে যে কি দুঃখের সাগরে ভাসাইয়া গেলেন, তাহা নলের তখন ভাবিয়া দেখিবার ক্ষমতা ছিল না। যখন দময়ন্তী জাগিয়া দেখিলেন, নল, নাই তখন যে তাহার কি কষ্ট হইল, আমার কি সাধ্য, তাহা বলিয়া বুঝাই! সে সময়ে তাহার দুঃখে বুঝি পাষাণও গলিয়া ছিল। তিনি পাগলিনীর ন্যায় মাটিতে গড়াগড়ি দিয়া কাঁদিলেন;বারবার অজ্ঞান হইয়া আবার জ্ঞান হইলে ছটফট করিয়া কাঁদিলেন;সন্ধ্যাকালে ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হইয়া, নল যে তাহাকে খুঁজিবেন সে কথা ভাবিয়া আকুল হইয়া দিলেন। কাদিতে কাঁদিতে নলের শত্রুদিগের উপর তাহার রাগ হইল। তিনি তাহাদিগকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “যে আমার পতিকে এমন কষ্টে ফেলিয়াছে, ইহার চেয়েও অধিক কষ্ট তাহার হইবে।”

 বিপদ প্রায়ই একেলা আসে না। দময়ন্তী ব্যাকুল হইয়া বনের ভিতরে নলকে খুঁজিতেছেন, এমন সময়, এক ভীষণ অজগর তাহার লকলকে জিব বাহির করিতে করিতে তাহাকে খাইতে আসিল। এমন দুঃখের সময়ে মৃত্যু হইলে ত আরামের কথাই হয়। দময়ন্তী অজগর দেখিয়া ভয় পাইলেন না। কিন্তু তাহার মনে হইল, “হায়! এই ঘোর অরণ্যের ভিতরে আমাকে সাপে খাইয়াছে। এ কথা শুনিলে না জানি, নলের মনে কতই কষ্ট হইবে।”

 যখন আর কেহই থাকে না:তখনো ভগবান থাকেন। তিনি কৃপা করিলে নিতান্ত ঘোরতর বিপদ হইতেও মানুষকে রক্ষা করিতে পারেন। দময়ন্তী অজগর দেখিয়া জীবনের আশা একেবারেই পরিত্যাগ করিয়াছেন, এমন সময় এক ব্যাধ আসিয়া সাপটাকে মারিয়া ফেলিল।

 তারপর বনের ভিতরে চলিতে চলিতে দময়ন্তী দেখিলেন যে, একটা ভয়ঙ্কর সিংহ তাহার দিকে আসিতেছে। সিংহকে দেখিবামাত্র তিনি তাহার নিকটে গিয়া বলিলেন, “হে পশুরাজ! আমি মহারাজ ভীমের কন্যা, নলের পত্নী। আমার নাম দময়ন্তী। যদি তুমি নলকে দেখিয়া থাক, তবে তাহার সংবাদ দিয়া আমার প্রাণ রক্ষা কর;নচেৎ আমাকে ভক্ষণ করিয়া আমার দুঃখ দূর কর।”

 সিংহ তাহার কথার কোন উত্তর না দিয়াই চলিয়া গেল, তখন দময়ন্তী পর্বতকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে গিরিরাজ! তুমি কি আমার নলকে দেখিয়াছ?” হায় হায়! পর্বতও তাহার প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না।

 এইরূপে দময়ন্তী পাগলিনীর বেশে মুনিদিগের আশ্রমে গিয়া উপস্থিত হইলেন। মুনিরা তাহাকে দেখিয়া স্নেহের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! তুমি কি এই বনের দেবতা? কেন মা তুমি এমন করিয়া কাঁদিয়া ফিরিতেছ?”

 দময়ন্তী বলিলেন, “ওগো, আমি দেবতা নই! আমি মানুষ, অতি দীন দুঃখিনী;আপনাদের কৃপা ভিক্ষা করিতেছি। মুনিঠাকুর, আমি মহারাজ ভীমের কন্যা দময়ন্তী। আমার স্বামীর কথা কি আপনারা শোনেন নাই? তিনি নিষধের রাজা। তাহার নাম নল। তাহার রূপ দেবতার মতন; তেজ সূর্যের মতন। ধর্ম আর সত্যের তিনি আশ্রয়। মুনিঠাকুর, আমি সেই নলের স্ত্রী; তাহাকে খুঁজিতে আপনাদের নিকটে উপস্থিত হইয়াছি। তিনি কি আপনাদের তপোবন আসিয়াছেন?”