পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৫১

 মুনিগণ বলিলেন, “মা তুমি স্থির হও! চক্ষের জল মুছ। আমরা নিশ্চয় বলিতেছি শীঘ্রই তোমার আর নলের দুঃখ দূর হইবে।”

 বলিতে বলিতে, আর সেখানে মুনিও নাই, আশ্রমও নাই। সকলই ভেল্কির মত আকাশে মিলাইয়া গেল। দময়ন্তী ভাবিলেন, “কি আশ্চর্য! আমি স্বপ্ন দেখিলাম?” চিন্তা করিতে করিতে তিনি এক নদীর তীরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে, অনেকগুলি বণিক হাতি, ঘোড়া, উট, আর গাড়িতে করিয়া বিস্তর জিনিসপত্র লইয়া সেই নদী পার হইতেছে। দময়ন্তী সেই সওদাগরদিগের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলে, তাহারা তাহাকে দেখিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেল। তাহাদের কেহ চিৎকার করিয়া উঠিল, কেহ ছুটিয়া পলাইল। কেহ তাহাকে পাগল মনে করিয়া বিদ্রুপ করিতে লাগিল। কেহ তাহাকে বনের দেবতা মনে করিয়া তাঁহার নিকট আশীর্বাদ চাহিতে আসিল; আবার কেহ কেহ তাহার অবস্থা দেখিয়া দয়া করিয়া তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল।

 দময়ন্তী তাহাদিগকে বলিলেন, “বাছাসকল, আমি মানুষ; রাজার মেয়ে, রাজার রাণী, নিষধের রাজা নল আমার স্বামী, আমি বনের ভিতরে তাহাকে হারাইয়া পাগলিনীর মত তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি! তোমরা কি তাহাকে দেখিয়াছ?”

 সেই বণিকদিগের দলপতির নাম ছিল শুচি। সে দময়ন্তীর কথায় বিনয় করিয়া বলিল, “মা, আমরা ত নল নামে কাহাকেও দেখিতে পাই নাই। এই বনের ভিতরে বাঘ ভালুক অনেক আছে। কিন্তু মানুষ ত খালি তোমাকেই দেখিলাম।”

 এই বলিয়া বণিকের দল যাইতে প্রস্তুত হইলে, দময়ন্তী তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কোন দেশে যাইবে?”

 বণিকেরা বলিল, “আমরা চেদীর রাজা সুবাহুর নিকট যাইব।”

 এ কথা শুনিয়া দময়ন্তীও সেই সওদাগরদিগের সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। তাহার মনে হইল যে, হয়ত বা পথে নলের সঙ্গে দেখা হইতে পারে। সওদাগরের দল সমস্ত দিন পথ চলিয়া একটা সুন্দর সরোবরেব ধারে উপস্থিত হইল। সবোবর দেখিয়া বণিকেরা বলিল, “কি সুন্দর স্থানটি। চল ভাই, ইহার ধারে বিশ্রাম করি।” এই বলিয়া তাহারা সরোবরের পশ্চিম ধারে একটি জায়গা দেখিয়া, সেইখানে রাত কাটাইবার আয়োজন করিল। হাতি ঘোড়া-গুলিকে গাছে বাধিয়া রাখিল। বহুদিন পথ চলিয়া সকলেরই অত্যন্ত পরিশ্রম হইয়াছিল, কাজেই তাহারা সকলে ঘুমাইয়া পড়িতে বেশি বিলম্ব হইল না।

 রাত দুপুর হইয়াছে, সকলে অচেতন হইয়া ঘুমাইতেছে, এমন সময় একদল বুনো হাতি সেই সরোবরে জল খাইতে আসিল। তাহারা তখন সদাগরদিগের পোষা হাতিগুলিকে দেখিতে পাইল, তখন আর তাহাদের রাগের সীমা রহিল না। তাহারা তৎক্ষণাৎ গভীর গর্জনে সেই পোষা হাতিগুলিকে তাড়া করিলে সেগুলি ভয়ে চিৎকার করিতে করিতে, হতভাগ্য সওদাগরদের উপর দিয়াই ছুটিয়া পলাইতে লাগিল। বেচারারা ভালো করিয়া বুঝিতেও পারিল না, কি হইয়াছে। তাহার পূর্বেই তাহাদের অধিকাংশ লোক হাতির পায়ের তলায় পড়িয়া পিষিয়া গেল।

 একদিকে এমন ভয়ানক বিপদ, অন্যদিকে বনে আগুন লাগিয়া প্রলয়কাণ্ড উপস্থিত। ধনরত্ন, জিনিসপত্র, যাহা কিছু ছিল, সে সর্বনেশে আগুন হইতে কিছুই রক্ষা পাইল না। হাতির