পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৫৫

“উহাদিগকে এখানে আনিতে পারিলে ত বিশেষ পুরস্কার দিবই, উহাদের সংবাদ আনিতে পারিলেও এক হাজার গরু আর খুব বড় একখানি গ্রাম দিব।”

 সুতরাং ব্রাহ্মণদিগের যতদূর সাধ্য ছিল, তাহারা খুঁজিতে কোনরূপ ত্রুটি করিলেন না, কিন্তু একে একে তাহাদের প্রায় সকলেই নল-দময়ন্তীর কোন সন্ধান করিতে না পারিয়া, দুঃখের সহিত ফিরিয়া আসিলেন।

 ইহাদের মধ্যে সুদেব নামক একজন অতি বুদ্ধিমান্ লোক ছিলেন। তিনি নানা স্থানে ঘুরিতে ঘুরিতে, চেদী নগরে আসিয়া, রাজবাড়ীতে সুনন্দার সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখিতে পাইলেন। মেয়েটির বেশ অতি দীন হীন, মুখখানি মলিন, আর শরীর জীর্ণ শীর্ণ হইয়া অস্থি চর্মসার হইয়াছে। তথাপি তাহার মনে হইল, যেন সেই মুখখানি তিনি ইহার পূর্বে কোথায় দেখিয়াছে। তিনি সেইখানে দাঁড়াইয়া এক দৃষ্টে মেয়েটিকে দেখিতে লাগিলেন। যত দেখিলেন, ততই তাহার নিশ্চয় মনে হইল যে, এই মেয়েটিই দময়ন্তী। শেষে তিনি আর থাকিতে না পারিয়া দময়ন্তীর নিকটে গিয়া বলিলেন, “বৈদর্ভি (অর্থাৎ বিদর্ভদেশের রাজার মেয়ে) আমি আপনার ভ্রাতার প্রিয় বন্ধু; আমার নাম সুদেব। মহারাজ ভীমের আজ্ঞায় আপনাকে খুঁজিতে আসিয়াছি, আপনার পিতা, মাতা, ভাই, সন্তান, সকলেই ভালো আছে; কিন্তু আপনার জন্য দিনরাত কেবলই তাহাদের চক্ষের জল পড়ে!”

 সুদেবকে দেখিবামাত্র তাহাকে চিনিতে পারিয়া দময়ন্তী কঁদিয়া উঠিলেন। তারপর কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া, এক এক করিয়া পিতা, মাতা, ভাই, বন্ধু সকলের সংবাদ লইতে লাগিলেন।

 এদিকে সুনন্দা যখন দেখিলেন যে, দময়ন্তী কাঁদিতেছেন, তখন তিনিও কাঁদিতে কাদিতে তাহার মার নিকট গিয়া বলিলেন, “মা, এক ব্রাহ্মণ কোথা হইতে আসিয়া দময়ন্তীকে কি সংবাদ দিয়াছে, তাহা শুনিয়া দময়ন্তী কঁদিতেছেন।”

 এ কথায় রাজার মা তখনই সুদেবকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, আপনি এই মেয়েটির পরিচয় জানেন বলিয়া বোধহয়। ইনি কে? কাহার কন্যা?”

 সুদেব কহিলেন, “মা, ইনি বিদর্ভরাজ মহাত্মা ভীমের কন্যা, ইহার নাম দময়ন্তী, বীরসেনের পুত্র মহারাজ নলের সহিত ইহার বিবাহ হয়। তারপর নল পাশায় রাজ্য হারাইয়া ইহাকে লইয়া দেশ ত্যাগ করেন সেই অবধি আমরা ইহাদিগকে খুঁজিয়া অস্থির হইয়াছি, কিন্তু এতদিন কোথাও ইহাদের সন্ধান পাই নাই। সমুদায় পৃথিবী ঘূরিবার পর আজ আপনার বাড়িতে এই মেয়েটিকে দেখিয়াই মনে হইল যে, ইনি দময়ন্তী; নহিলে এমন সুন্দর আর কে হইবে। ইহার দুটি ভ্রুর মাঝখানে একটি পদ্মের মতন জরুল আছে। মুখখানি মলিন হইয়া যাওয়াতে বোধ হয়, তাহা আপনাদের চক্ষে পড়ে নাই, কিন্তু আমি তাহা স্পষ্ট দেখিতেছি।”

 সুনন্দা অমনি ভিজা গামছা আনিয়া, পরম যত্নে দময়ন্তীর কপালখানি ঘষিয়া পরিষ্কার করিলেন। তখন দেখা গেল যে, সত্য সত্যই ভূর মাঝখানে ঠিক পদ্মের আকৃতি একটি অতি সুন্দর জরুল রহিয়াছে। তাহা দেখিয়া রাজমাতা আর সুনন্দা দুজনেই দময়ন্তীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া অস্থির হইলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে রাজমাতা বলিলেন, “মাগো তুই এতদিন আমার বুকের এত কাছে ছিলি, তবু আমি তোকে চিনিতে পারি নাই। আমি যে মা তোর আপনার মাসী, আমার পিতার ঘরে তোকে হইতে দেখিয়াছি। তোর মা আর আমি দশার্ণ দেশের রাজা সুদামের মেয়ে। তোর মার বিবাহ হইল ভীমের সঙ্গে, আর আমাকে বাবা