পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৫৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

দিলেন এই অযোধ্যার রাজা বীরবাহুর হাতে। মা, তুই তোর আপনার ঘরে আসিয়াছিলি; এখানকার সকলই তোর।”

 তখন দময়ন্তী কাঁদিতে কাদিতে রাজমাতার পায়ের ধুলা লইয়া বলিলেন, “মা, আমিও আপনাকে চিনিতে পারি নাই, আপনিও আমাকে চিনিতে পারেন নাই। তবুও ত মা আপনার নিজের মেয়ের মতই যত্নে এতদিন আপনার আশ্রয়ে বাস করিয়াছি। সুনন্দা আমাকে যে স্নেহ দিয়াছে কোন্ ভাই বোন তাহার চেয়ে বেশি দিতে পারে! মাগো, এরপর এখানে থাকিলে আমার প্রাণে নিশ্চয় আরো সুখ হইত। কিন্তু এখন একটিবার বাবাকে আর খোকাখুকিকে দেখিবার জন্য আমার মন বড়ই অস্থির হইয়াছে। দয়া করিয়া আমাকে শীঘ্র বিদর্ভ নগরে পাঠাইয়া দিন।”

 রাজমাতা বলিলেন, “মা তুমি যথার্থই বলিয়াছ। আমার প্রাণ যদি তোমাকে দেখিয়া এমন করে, তবে না জানি তোমার বাপ মায়ের প্রাণ তোমার জন্য কি করিতেছে। মা, তুমি প্রস্তুত হও। আমি তোমাকে পাঠাইবার আয়োজন করিতেছি।

 রাজমাতার কথায় তখনই জরির সাজ দেওয়া হাতির দাঁতের পাল্কি প্রস্তুত হইয়া আসিল। পাগড়ি আঁটিয়া দশ হাজার সিপাহী তাহার সঙ্গে যাইবার জন্য ঢাল তলোয়ার বল্লম হাতে হাজির হইল।

 এদিকে সুনন্দা নিজ হাতে দময়ন্তীকে স্নান করাইয়া সাজা‍ইয়া প্রস্তুত করিয়াছে। পাল্কি আর লোকজন পথ খরচের সকল আয়োজন লইয়া উপস্থিত হইলে, তিনজনে মিলিয়া কিছুকাল কাঁদিলেন। তারপর দময়ন্তী তাহার মাসীমার পায়ের ধূলা লইলে, আব সুনন্দার গলা জড়াইয়া তাঁহাকে চুমো খাইলে, রাজমাতা ভক্তিভরে দেবতার নাম করিতে করিতে তাহাকে পাল্কিতে তুলিয়া দিলেন।

 দময়ন্তী বিদর্ভ দেশে পৌছিলে তাঁহার পিতা-মাতা আর আত্মীয়েবা কিরূপ আনন্দিত হইলেন, আর রাজা সুদেবকে তাহার আশার অধিক কত ধনরত্ন দিলেন, এ-সকল আমরা কল্পনা করিয়া লইতে পারি। দময়ন্তীও অবশ্য পিতামাতা আর সন্তান দুটিকে দেখিয়া ক্ষণকালের জন্য আনন্দিত হইলেন; কিন্তু তাহার পরেই আবার নলের চিন্তা আসিয়া, তাহার মুখের হাসি নিভাইয়া দিল! রাজা আর রাণী স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে, নলের সন্ধান না করিতে পারিলে দময়ন্তীকে বাঁচান কঠিন হইবে।

 সুতরাং আবার ব্রাহ্মণগণ দেশ বিদেশে নলের সন্ধানে যাত্রা করিতে প্রস্তুত হইলেন। ব্রাহ্মণেরা দময়ন্তীর নিকট বিদায় লইতে আসিলে, দময়ন্তী তাহাদিগকে বলিয়া দিলেন, “আপনারা সকল দেশের পথে, ঘাটে, বাজারে, আর রাজসভায় এই কথা বারবার বলিবেন, “হে শঠ! বনের ভিতর ঘুমের মধ্যে দুঃখিনীকে ফেলিয়া কোথায় পলায়ন করিয়াছ? দুঃখিনী সেই আধখানি কাপড় পরিয়া কেবল তোমার জন্য চক্ষের জল ফেলিতেছে!” এ কথায় যদি কেহ কোন উত্তর দেন, তবে তিনি কে, কোথায় থাকেন, কি কেন, এ-সকল সংবাদ বিশেষ করিয়া জানিয়া আসিবেন।”

 ব্রাহ্মণেরা কত দেশে, কত বাজারে, কত সভায়, কত বনে, এই কথা চিৎকার করিয়া বলিলেন। লোকে তাহা শুনিয়া কত আশ্চর্য হই, কত বিদ্রুপ করিল, কিন্তু কথার উত্তর কেহ দিতে আসিল না। ক্রমে, একজন ছাড়া ব্রাহ্মণদিগের সকলেই ফিরিয়া আসিলেন।