পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৫৭

 যে ব্রাহ্মণ তখনো ফিরেন নাই, তাহার নাম ছিল পর্ণাদ। অন্যেরা ফিরিবার পরেও, তিনি অনেকদিন ধরিয়া দেশে দেশে ঘুরিতে লাগিলেন। শেষে একদিন অযোধ্যায় ঋতুপর্ণের সভায় গিয়া, দময়ন্তীর ঐ কথাগুলি বলিলেন। সভায় কেহই তাহার কথার উত্তর দিল না, কিন্তু তিনি সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার সময়, রাজার বাহুক নামক সারথি চুপি চুপি তাহাকে ডাকিয়া একটা নির্জন স্থানে লইয়া গেল। লোকটি দেখিতে কুৎসিত, আর বেঁটে। তাহার হাত দুখানি সেই বেঁটে মানুষের পক্ষে নিতান্ত ছোট।

 বাহুক সেই ব্রাহ্মণকে নির্জনে লইয়া গিয়া বলিল, “নল নিতান্ত কষ্টের দশায় পাগলের মত হইয়া দময়ন্তীকে ছাড়িয়া যায়। তখন হইতেই তিনি দারুণ মনোদুঃখে কাল কাটাইতেছে। এমত অবস্থায় দময়ন্তী যেন তাহার উপর রাগ না করেন।”

 বাহুকের মুখে এ কথা শুনিয়া পর্ণাদ আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব করিলেন না। তিনি দিনরাত পথ চলিয়া, যত শীঘ্র সম্ভব, বিদর্ভ দেশে উপস্থিত হইয়াই, দময়ন্তীকে সকল কথা অবিকল বলিলেন। তাহা শুনিয়া দময়ন্তী পর্ণাদকে তাঁহার আশার অধিক ধনরত্ন দানে তুষ্ট করিয়া বলিলেন, “ঠাকুর, আপনি আমার যে উপকার করিলেন, তাহার পুরস্কার আপনাকে আমি কি দিব? নল আসিলে, আপনি আরো ধন পাইবেন।”

 ব্রাহ্মণ যাহা পাইছিলেন তাহাতেই যার পর নাই সন্তুষ্ট হইয়া দময়ন্তীকে আশীর্বাদ করিতে করিতে ঘরে চলিয়া গেলেন। তারপর দময়ন্তী তাহার মার নিকট গিয়া বলিলেন, “মা, সুদেবকে দিয়া আমি একটা কাজ করাইব; তুমি কিন্তু তাহা বাবাকে জানাইতে পারিবে না।”

 রানী এ কথায় সম্মত হইলে, তিনি তাঁহার সম্মুখে সুদেবকে ডাকাইয়া আনিয়া বলিলেন, “ভাই সুদেব, তুমি ভিন্ন আর কেহ এ কাজ করিতে পারিবে না। তোমাকে ঋতুপর্ণ রাজার সভাতে যাইতে হইবে। সেখানে গিয়া তুমি বলিবে, “মহারাজ, কাল সকালে দময়ন্তীর আবার স্বয়ম্বর হইবে। আপনাদের যদি সেখানে যাইতে ইচ্ছা হয়, তবে আজ রাত্রির মধ্যেই যাহাতে বিদর্ভ দেশে গিয়া পৌছাইতে পারেন, তাহার উপায় করুন। কাল সূর্য উঠিলেই স্বয়ম্বরের কাজ শেষ হইয়া যাইবে।”

 এক রাত্রির মধ্যে অযোধ্যা হইতে বিদর্ভ দেশে যাওয়ার ক্ষমতা একমাত্র নলেরই ছিল, পৃথিবীতে আর-একটি লোকেরও এ কাজ করিবার সাধ্য ছিল না। ঋতুপর্ণের ঐ বাহুক নামক সারথি যদি বাস্তবিকই নল হন, তবে তিনি একরাত্রির ভিতরেই ঋতুপর্ণকে বিদর্ভ নগরে আনিতে পারিবেন। ঋতুপর্ণ একরাত্রির ভিতরে বিদর্ভ দেশে পৌছাইতে পারিলে, নিশ্চয় বুঝা যাইবে যে, তাঁহার সারথির চেহারা যেমনই হউক, সে নল ভিন্ন আর কেহ নহে।

 দময়ন্তীর কথা শুনিয়া রাণী আর সুদেব দুজনেই তাহার বুদ্ধির প্রশংসা করিতে লাগিলেন। সুদেবের তখন এতই আনন্দ আর উৎসাহ হইল যে, তিনি সেই দণ্ডেই বায়ুবেগে অযোধ্যার পানে ছুটিয়া চলিলেন।

 সুদেবের নিকট দময়ন্তীর সংবাদ শুনিয়া, ঋতুপর্ণ তখনই বাহককে ডাকিয়া বলিলেন “বাহুক শুনিলাম, আবার নাকি দময়ন্তীর স্বয়ম্বর হইবে! আজ রাত্রির মধ্যে বিদর্ভ দেশে পৌছাইতে পারিলে, আমি সেই স্বয়ম্বরে উপস্থিত থাকিতে পারিব। এ কথায় তুমি কি বল?

 এক রাত্রির মধ্যে সেখানে পৌছাইতে পারিবে কি?”