পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৫৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 হায়, বেচারা বাহুক! রাজার কথায় সে উত্তর দিবে কি, তাঁহার সামনে স্থির হইয়া দাঁড়ানই তাহার পক্ষে নিতান্ত কঠিন হইল। তাহার মনে হইল, যেন তাহার বুকের ভিতর দশ জন লোকে হাম্বর (কামারদের প্রকাণ্ড হাতুড়ি) পিটিতে আরম্ভ করিয়াছে! মাথাটা যেন ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে। নিতান্ত রাজার সামনে বলিয়া সে অনেক কষ্টে চোখের জল আর কান্না থামাইয়া রাখিল।

 যাহা হউক এভাবে অতি অল্প সময়ই গিয়াছিল। তাহার পরেই সে বুঝিতে পারিল যে, ‘দময়ন্তীর আবার স্বয়ম্বর হইবে, ইহা কখনই হইতে পারে না। আমার সন্ধান করিবার জন্যই সে এই কৌশল করিয়াছে!’ তখন সে রাজাকে বলিল, “হা ঁমহারাজ! আপনার অনুমতি হইলে, আমি একরাত্রির ভিতরেই মহারাজকে বিদর্ভ দেশে পৌছাইয়া দিতে পারি।”

 রাজা বলিলেন, “তবে শীঘ্র অশ্বশালায় গিয়া আটটি খুব ভালো ঘোড়া বাছিয়া আন। যেসে ঘোড়া এত তাড়াতাড়ি কিছুতেই যাইতে পারিবে না।”

 বাহুক ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া চলিয়া গেল, আর খানিক বাদে আটটি রোগা-রোগা ঘোড়া লইয়া উপস্থিত হইল। রাজা বলিলেন, “ও কি ও! এ বেচারারা যে দেখিতেছি নিজের শরীর লইয়াই ভালো করিয়া চলিতে পারে না। এই ঘোড়া লইয়া তুমি একদিনে বিদর্ভ দেশে যাইবে, মনে করিয়াছ?

 বাহুক বলিল, “মহারাজ, যদি কোন ঘোড়া পারে, তবে এই-সকল ঘোড়াই আপনাকে বিদর্ভ দেশে লইয়া যাইতে পারিবে। আপনার কোন চিন্তা নাই। ইহারা পক্ষীবাজ ঘোড়া।”

 রাজা বলিলেন, “এ বিষয়ে তুমি আমাদের চেয়ে ঢের বেশি জান, তোমার যাহা ভালো মনে হয়, তাহাই কর।”

 রাজার কথায় নল ঘোড়াগুলিকে রথে জুতিলেন। তারপর রাজা বারবার তাহাদের দিকে চাহিতে চাহিতে, নিতান্ত সন্দেহের সহিত রথে গিয়া চড়িলেন। অমনি ঘোড়াগুলি তাহার ভার সহিতে না পারিয়া মুখ থুবড়িয়া পড়িয়া গেল। কিন্তু বাহুক তথাপি অন্য ঘোড়া লইল না। সেই ঘোড়াগুলিকে সে চাপড়াইয়া আর হাত বুলাইয়া শান্ত করিল, তারপর বার্ষ্ণেয়কে রথের পিছনে তুলিয়া সে রথ ছাড়িয়া দিল।

 যে ঘোড়া এইমাত্র লোকের ভার সহিতে না পারিয়া পড়িয়া গিয়াছিল, বাহুকের হাতে পড়িয়া সেই ঘোড়া এমনি তেজের সহিত রথ লইয়া ছুট দিল যে, রাজা ত দেখিয়া একেবারে অবাক। ক্রমে দেখা গেল যে, ঘোড়ার পা আর মাটি ছোঁয় না। দেখিতে দেখিতে তাহারা রথখানিকে সুদ্ধ শূন্যে উঠাইয়া লইয়া চলিল। ইহা দেখিয়া বার্ষ্ণেয় ভাবিল, “সামান্য একজন সারথির এমন অসাধারণ ক্ষমতা এ কথা ত কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। এ ব্যক্তি যদি এমন কদাকার আর বেঁটে না হইত, তবে নিশ্চয় মনে করিতাম, এ আমার প্রভু নল। তিনি ভিন্ন এই পৃথিবীতে আর কাহারো এমন ক্ষমতা নাই। অথচ এ ব্যক্তি যে নল নহে, এ কথা ত তাহার চেহারাতেই প্রমাণ হইতেছে, তবে কি ইনি কোন দেবতা?”

 রাজা বাহুকের ক্ষমতা দেখিয়া এতই আশ্চর্য হইয়াছে যে তাহার মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইতেছে না, কত নগর, কত বন, কত নদী, কত পর্বত যে তাহারা ইহারই মধ্যে পার হইয়াছেন তাহার লেখাজোখা নাই। হাওয়ার জোর এত হইয়াছে যে, তিনি তাহার চাদরখানিকে দুহাতে প্রাণপণে আঁকড়িয়া ধরিয়াও গায়ে রাখিতে পারিতেছেনা। শেষে সে চাদর মহারাজের