পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

গোপন করিয়া কেশিনীকে বলিল, “আমি বলিয়াছিলাম যে, নল নিতান্ত কষ্টের দশায় পাগলের মত হইয়া দময়ন্তীকে ছাড়িয়া যান। তখন হইতেই তিনি দারুণ মনোদুঃখে কাল কাটাইতেছেন। এমন অবস্থায় দময়ন্তী যেন তাহার উপর রাগ না করেন।”

 বলিতে বলিতে বেচারার মুখে আর কথা সরিল না, সে দুহাতে মুখ ঢাকিয়া একেবারে কাঁদিয়াই ফেলিল।

 এসকল কথা কেশিনীর মুখে শুনিয়া দময়ন্তীরও বড়ই কষ্ট হইল। কিন্তু তিনি অনেক কষ্টে নিজেকে স্থির রাখিয়া বলিলেন, ‘কেশিনি, তুমি আবার যাও। তিনি কখন কি করেন বেশ ভালো করিয়া দেখিবে। তিনি আগুন চাহিলে আগুন আনিতে দিবে না। জল চাহিলে যাহাতে জল না পান, তাহা করিবে।”

 কেশিনী চলিয়া গেল। অনেকক্ষণ পরে সে নিতান্ত ব্যস্তভাবে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “এমন আশ্চর্য মানুষ ত আমি আর কখনো দেখি নাই! এতটুকু ছোট দরজা দিয়া ঢুকিবার সময়ও মাথা হেঁট করেন না। তিনি কাছে গেলেই দরজা আপনি বড় হইয়া যায়। খালি কলসীর দিকে তিনি একটিবার শুধু তাকাইলেই তাহা জলে ভরিয়া যায়। খড়ের গোছ হাতে করিয়া কি একটা কথা ভাবেন আর অমনি তাহা দপ করিয়া জ্বলিযা উঠে। আগুনের ভিতর তিনি হাত ঢুকাইয়া দিলেও তাহা পুড়ে না। জল অমনি তাহার ঘটিতে আসিয়া উপস্থিত হয়, গড়াইতে হয় না। ফুল হাতে লইয়া চটকাইতে লাগিলেন, সে ফুল নষ্ট না হইয়া আরো ভালো করিয়া ফুটিয়া উঠিল, আর তাহার ভিতর হইতে আরো চমৎকার গন্ধ বাহির হইতে লাগিল।”

 তখন দময়ন্তীর মন আনন্দে অধীর হইয়া উঠিল। তিনি নিশ্চয় বুঝিতে পারিলেন যে এই ব্যক্তির আকৃতি যেমনই হউক ইনি নল ভিন্ন আর কেহ নহেন। তথাপি তাহার মনে হইল যে, সকল সন্দেহ ভালো মত দূর করা উচিত। তাই তিনি কেশিনীকে বলিলেন, “কেশিনি, ইহার রাঁধা ব্যঞ্জন একটু খাইয়া দেখিতে পারিলে আমার মনের সকল সন্দেহ দূর হয়। তুমি আবার গিয়া উহার রাধা একটু ব্যঞ্জন চাহিয়া আন।”

 কেশিনী বাহুকের নিকট হইতে তাহার প্রস্তুত ব্যঞ্জন চাহিয়া আনিল। সে ব্যঞ্জন রাঁধিবার শক্তি আর কাহারই ছিল না।

 অনেক কষ্টে দময়ন্তী কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া মুখ ধুইলেন। তারপর ইন্দ্রসেন আর ইন্দ্রসেনাকে কেশিনীর হাতে দিয়া বলিলেন, “একটিবার তুমি ইহাদিগকে তাহার নিকট লইয়া যাও দেখি, তিনি ইহাদিগকে দেখিয়া কি করেন।”

 কেশিনী শিশু দুটিকে বাহুকের নিকট লইয়া যাইবামাত্র সে তাহাদিগকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া নিতান্ত আকুলভাবে কাঁদিতে লাগিল। কিন্তু পাছে তাহার কান্না দেখিয়া লোকে তাহাকে চিনিয়া ফেলে, তাই সে তাড়াতাড়ি সামলাইয়া গিয়া, কেশিনীকে বলিল, “আমার ঠিক এমনি দুটি খোকা খুকি ছিল, তাই ইহাদিগকে দেখিয়া আমার কান্না পাইতেছে। তুমি ইহাতে কিছু মনে করিও না। এখন তবে তুমি ইহাদিগকে লইয়া ঘরে যাও, আমার একটু কাজ কর্ম আছে।”

 বাহুকই যে নল এতক্ষণে আর দময়ন্তীর মনে এ বিষয়ে কোন সন্দেহই রহিল না। তবে চেহারার এতটা তফাৎ কি করিয়া হইল এ কথায় মীমাংসা অবশ্য একবার দুজনের দেখা