পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৬৭

 সাবিত্রী বলিলেন, আমি যখন তাঁহাকে বরণ করিয়াছি। তখন তিনিই আমার পতি। তাঁহার আয়ু অল্প হয় হউক, আমি তাঁহাকে ছাড়িয়া অন্য কাহাকেও বরণ করিব না।

 তাহা শুনিয়া নারদ বলিলেন, মহারাজ, তোমার কন্যার বুদ্ধি বড়ই স্থির, ধর্মে ইহার মতি নিতান্তই অটল। আমি বলি, সত্যবানের সহিতই ইহার বিবাহ দাও। সত্যবানের ন্যায় গুণবান্ লোক আর নাই।

 রাজা বলিলেন, আপনি আমার গুরু, আপনি যাহা বলিলেন, তাহাই হউক।

 নারদ বলিলেন, “আচ্ছা, তবে আমি এখন আসি। তোমাদের মঙ্গল হউক।

 এই বলিয়া নারদ চলিয়া গেলেন, আর অশ্বপতি সাবিত্রীর বিবাহের আয়োজন করিতে লাগিলেন। তারপর শুভ দিন স্থির করিয়া, ব্রাহ্মণ পুরোহিত সকলের সহিত রাজা সাবিত্রীকে লইয়া সেই বনের ভিতরে দ্যুমৎসেনের নিকট উপস্থিত হইলেন।

 অন্ধ রাজা দ্যুমৎসেন এক শাল গাছের তলায় কুশাসনে বসিয়া আছে, এমন সময়, অশ্বপতি সেখানে গিয়া বলিলেন, ‘মহারাজ, আপনাকে নমস্কার করিতেছি, আপনি ভালো আছেন ত? আমি মদ্রদেশ হইতে আসিয়াছি, আমার নাম অশ্বপতি।

 দ্যুমৎসেন পরম সমাদরে তাঁহাকে অর্ঘ্য আর আসন দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মহারাজ, কি জন্য আসিয়াছেন?'

 অশ্বপতি বলিলেন, “মহারাজ, আমার সাবিত্রী নাম্নী কন্যাটি পরম সুন্দরী ও গুণবতী। আমি তাহাকে আপনার নিকট উপস্থিত করিয়াছি, স্নেহপূর্বক ইহাকে আপনার পুত্রবধু করুন।

 দ্যুমৎসেন যার পর নাই আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “মহারাজ, আমরা বনবাসী দরিদ্র লোক। আপনার কন্যা কি করিয়া বনবাসের দুঃখ সহ্য করিবেন?

 অশ্বপতি বলিলেন, ‘আমার কন্যা তাহা পারিবে, আর তাহার ভিতরেই সুখে থাকিবে। ইহার জন্য আপনি কোন চিন্তা করিবেন না।

 দ্যুমৎসেন বলিলেন, “আমার রাজ্য নাই, তাই আমি ওরূপ কহিতেছিলাম। নহিলে, আপনার কন্যা আমার বধূ হইবেন, ইহার চেয়ে সুখের আর কি হইতে পারে?”

 বনের ভিতর যত তপস্বী ছিলেন, তাহারা সকলেই সাবিত্রী আর সত্যবাকে জানিতেন।

 বিবাহের নিমন্ত্রণ পাইয়া তাহারা আনন্দের সহিত আসিয়া দুমৎসেনের আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের সকলের আশীর্বাদে এই সুখের ব্যাপার অতি সুন্দররূপেই শেষ হইল। সাবিত্রীকে যথার্থ সুপাত্রে দান করিয়া অশ্বপতির মনেও আনন্দের সীমা রহিল না।

 তারপর রাজা রানী, ব্রাহ্মণ পুরোহিত সকলে মিলিয়া বিদায় হইয়া গেলে, সাবিত্রী মনের সুখে স্বামী আর শ্বশুর শাশুড়ীর সেবা করিতে লাগিলেন। রাজবেশ পরিত্যাগপূর্বক তপস্বিনীর কষায় বসন (গেরুয়া কাপড়) পরিয়া যেন তাহার কতই আরাম বোধ হইতে লাগিল।

 সাবিত্রী নারদের সেই নিদারুণ কথা এক মুহূর্তের তরেও ভুলেন নাই। বৎসরের শেষ যতই কাছে আসিতে লাগিল, ততই সেই ভীষণ বিপদের চিন্তা অন্য সকল চিন্তাকে ডুবাইয়া দিয়া, তাহাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিল। প্রতিদিন দিন গণিয়া যখন তিনি দেখিলেন যে, আর চারিটি দিন মাত্র বাকি আছে, তখন তিনি আহার নিদ্রা একেবারেই পরিত্যাগ করিয়া, একমনে কেবল ভগবানকে ডাকিতে লাগিলেন। এইরূপে তিনদিন চলিয়া গেল। তারপর সেই দিন আসিয়া উপস্থিত হইল, যেদিন সত্যবান্ তাহাকে চিরকালের মত ছাড়িয়া যাইবেন।