পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 সেদিন সকালে উঠিয়া সাবিত্রী সকলের আগে ভক্তিভরে দেবতার পূজা করিলেন। তারপর গুরুজনদিগের চরণে প্রণাম করিয়া জোহাতে তাহাদের সম্মুখে দাঁড়াইলে, তাহারা বহুকষ্টে চোখের জল থামাইয়া আশীর্বাদ করিলেন, “তোমার পতি বাঁচিয়া থাকুন।”

 চিন্তায় এবং অনাহারে সাবিত্রীর দেহ ক্ষীণ হইয়া যেন তাহার ছায়াখানি মাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে। তাহা দেখিয়া তাঁহার শ্বশুর শাশুড়ীর মনে বড়ই কষ্ট হইল।

 তাহারা বলিলেন, “মা, তিনদিন জলটুকুও মুখে দাও নাই, এখন আহার কর” সাবিত্রী তাহাদিগকে বিনয় করিয়া বলিলেন, “আজিকার দিনটি আমাকে ক্ষমা করুন, সূর্য অস্ত গেলে আমি আহার করিব।”

 কথায় বার্তায় বেলা হইল। সত্যবান্ কুড়াল কাঁধে লইয়া কাঠ আনিবার জন্য বনে যাইতে প্রস্তুত হইলেন, তাহা দেখিয়া সাবিত্রী বলিলেন, “আজি আমি কিছুতেই তোমার কাছ ছাড়া হইব না; আমাকে সঙ্গে লও।”

 সত্যবান্ বলিলেন, “সাবিত্রি, তুমি ত কখনো বনে যাও নাই, তাহাতে তোমার শরীর এত দুর্বল। তুমি কি করিয়া পথ চলিবে? কি করিযা বনের কষ্ট সহ্য করিবে?”

 সাবিত্রী বলিলেন, “আমার কোনো কষ্ট হইবে না। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে বারণ করিও না।”

 সত্যবান্ বলিলেন, “তুমি যাহাতে সুখী হও, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত। কিন্তু মা, বাবা কি তোমাকে যাইতে দিবেন?”

 সাবিত্রী শ্বশুর শাশুড়ীর পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “বাবা, মা আজিকার দিনে দয়া করিয়া আমাকে ইহার সহিত যাইতে দিন।”

 দ্যুমৎসেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “এক বৎসর সত্যবানেব বিবাহ হইয়াছে, ইহার মধ্যে মা আমার কোনদিন কিছু প্রার্থনা করেন নাই। আজ তাহার এই প্রথম আবদার আমি কোন প্রাণে অগ্রাহ্য করিব? যাও মা, আজ তুমি সত্যবানের সঙ্গে সঙ্গেই থাক।”

 দুজনে মিলিয়া বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। চারিদিকে শোভার অন্ত নাই; ফল ফুলে বন পরিপূর্ণ হইয়া আছে। নদীতে হাঁস খেলিতেছে, গাছে বসিয়া পাখি গান গাহিতেছে, সত্যবানের আজ আনন্দ ধরে না। তিনি ক্রমাগত বলিতেছে, “সাবিত্রি, দেখ, দেখ!” হায়! সাবিত্রী কি দেখিবেন? বাহিরের ঘটনা স্বপ্নের মত তাহার চক্ষে সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইতেছে কিন্তু তাহার মন তাহার কোন সংবাদই লইতেছে না। সেই নিদারুণ মুহূর্ত কখন আসিয়া উপস্থিত হয়, এই চিন্তায় অন্য সকল কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়া, তিনি বারবার কেবল সত্যবানকেই চাহিয়া দেখিতেছেন।

 ক্রমে বেলা পড়িয়া আসিল, সাজি ফলে ভরিয়া গেল। তারপর সত্যবান্ কাঠ কাটিতে আরম্ভ করিলেন। কাটিতে কাটিতে তিনি বলিলেন, “সাবিত্রি, আমার বড় মাথা ধরিয়াছে শরীর কেন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে; বুক যেন ফাটিয়া যাইতেছে। আমি আর দাঁড়াইতে পারিতেছি না; একটু নিদ্রা যাইব।”

 অমনি নারদ মুনির সেই কথা সাবিত্রীর মনে হইল। কিন্তু তাহার জন্য আর ব্যস্ত না হইয়া, তিনি সত্যবানের মাথাটি নিজের কোলে লইয়া;স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন, কিঞ্চিৎ পরেই তিনি দেখিলেন যে, এক ভয়ঙ্কর পুরুষ হঠাৎ কোথা হইতে সত্যবানের নিকট আসিয়া, একদৃষ্টে