পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৭৫

একটি পুকুর!

 তখন রাজামহাশয় কেবল পিপাসার জ্বালার কথাই ভাবিতেছিলেন, জলের ভয়ের কথা তাঁরা মনেই ছিল না। তাই পুকুর দেখিবামাত্র তিনি অতিশয় আনন্দিত হইয়া রানীকে ডাকিলেন, তারপর দুইজনে জলে নামিয়া স্নান করিতে গেলেন।

 স্নানের পর শীতল হইয়া রাজা তীরে আসিলেন, কিন্তু হায়রে হায়! রানী সেই জলে ডুবিলেন, আর ভাসিলেন না। রাজার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল, রাজ্যময় হুলুস্থুল পড়িয়া গেল। জেলেরা আসিয়া জাল দিয়া পুকুর ছাঁকিল, কিন্তু কিছুই পাইল না। পুকুরের জল সেঁচিয়া ফেলা হইল, কিন্তু তাহাতে কিছুই ফল হইল না, খালি দেখা গেল, এক গর্তের মুখে একটি ব্যাঙ বসিয়া আছে।

 ব্যাঙ দেখিয়া রাজা ক্রোধভরে বলিলেন, ‘এই দুষ্টই আমার রানীকে খাইয়াছে! সুতরাং তোমরা সকলে মিলিয়া ব্যাঙ বধ কর। যে যত ব্যাঙ মারিবে, আমি তাহার উপর তত খুশি হইব, এবং তাহাকে তত বেশি পুরস্কার দিব!

 এ কথায় ছেলে বুড়ো সকলে তখনই লাঠি আর ঝুড়ি হাতে ব্যাঙ মারিবার জন্য ছুটিয়া বাহির হইল। জলের ধারে, বনের ভিতরে, ঘরের কোণে, সারাদিন খালি ধুপ ধাপ ভিন্ন আর কোন শব্দ শুনিবার জো রহিল না। রাজবাড়ীর দিকে অবিরাম লাঠি বগলে, ঝুড়ি মাথায় লোকের স্রোত বহিতে লাগিল। রাজামহাশয় সভায় আসিয়া আর অন্য কোন শব্দ শুনিতে পাইতেন না, খালি, ‘জয় হোক মহারাজ! এক ঝুড়ি ব্যাঙ আনিয়াছি!’ দিনরাত্রি এই কথাই তাঁহাকে শুনিতে হইত।

 আর বেচারা ব্যাঙদিগের কথা কি বলিব? খোলা জায়গা পাইলে তাহাদিগকে তাড়াইয়া মারে, জলে ঝাঁপ দিলে ছাঁকিয়া আনে, বনে লুকাইলে খুঁজিয়া বাহির করে, গর্তে ঢুকিলে খুঁড়িয়া তোলে। তাহারা প্রাণের ভয়ে নিতান্ত কাতর হইয়া তাহাদের রাজার নিকট গিয়া বলিল, “দোহাই মহারাজ! আমাদিগকে রক্ষা করুন, রাজার লোক আমাদিগকে মারিয়া শেষ করিল।

 তখন ব্যাঙের রাজা তপস্বীর বেশে পরীক্ষিতের নিকট উপস্থিত হইয়া বিনয়পূর্বক বলিলেন, 'মহারাজ, ভেকদিগের কোন অপরাধ নাই, তুমি তাহাদের উপর ক্রোধ করিও না।

 রাজা বলিলেন, তাহা হইতে পারে না। ঐ দুরাত্মারা আমার রানীকে খাইয়াছে উহাদিগকে অবশ্য বধ করিব।

 ব্যাঙের রাজা বলিলেন, ‘তোমার রানী আমারই কন্যা! উহার নাম সুশোভনা। আমার নাম আয়ু, আমি ব্যাঙদিগের রাজা। আমি বেশ জানি, তোমার রানীকে কেহই খায় নাই।

 এ কথায় রাজা নিতান্ত আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, তবে আপনার কন্যাকে আনিয়া দিন।

 ইহাতে আয়ু সুশোভনাকে রাজার নিকট উপহিত করিয়া, তাঁহাকে বলিলেন, ‘সুশোভনা, তুমি মহারাজকে এমন করিয়া কষ্ট দিয়াছ ইহাতে আমি বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়াছি, এই অপরাধে তোমার সন্তানেরা ব্রাহ্মণদিগের সহিত বন্ধুতা করিতে পারিবে না।

 রানীকে পাইয়া রাজার আনন্দের আর সীমা রহিল না। তিনি ভক্তিভরে শ্বশুরকে প্রণাম করিয়া নানারূপ মিষ্ট কথায় তাঁহাকে তুষ্ট করিলেন, তারপর আয়ু, রাজা ও রানীকে আশীর্বাদ করিয়া দেশে চলিয়া গেলেন।